Saturday, June 23, 2018

সরলরেখা : দু'জন এবং... : ৯

  প্রতিটা বাড়িতে, প্রতিটা মানুষের  একটা নিজস্ব ঘর থাকে; চারদেওয়ালে আটকানো নয়,তবে চারদেওয়ালের চেয়েও বেশী নিভৃত... একটা নিজের জায়গা...

একটা ছোট বারান্দা  বা একটা ভাঙা আলমারি,  একটা চৌকির তলা বা একটা কাঠের বাক্স, একটা সিঁড়ির কোণ,  হয়তো বা পেয়ারা গাছের তলায় বাগানের একটুকরো, কিংবা ওই একখানা বক্স জানলা.... একটা  নিজের জায়গা...

যেখানে সবথেকে ভালো ঘুম আসে, যেখানটায় এসে পড়ে সবথেকে মিঠে রোদ্দুর,  যেখানে সবচেয়ে কাছ থেকে পাওয়া যায় মায়ের আঁচলের গন্ধ আর সবচেয়ে স্পষ্ট শোনা যায় দিদার সেলাইমেশিনের শব্দ, যে জায়গাটা থেকে দেখা যায় শব্দছকের সমাধান করতে করতে একটু-একটু হাসছে দাদু  আর দাড়ি কামাতে কামাতে বাবা গাইছে কিশোরকুমারের গান...

একটা নিজের জায়গা...

 যেখানে  খানিকক্ষণ এক্কেবারে  চুপ করে বসা যায়... লিখে রাখা যায় যা যা মনে আসছে... গাওয়া যায় সুর-নড়বড়ে সবেমাত্র তোলা গানটা...লুকিয়ে রাখা যায় গোলাপী চিরকুট, আঁকার খাতা...ছোটবেলার ঘুঙুর... মোমরঙের টুকরো রাখা যায় যত্ন করে...
যেখানে বসে কাঁদলে দেখতে পায়না কেউ...যার পাশেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জানলাটা...
সেখানে... একটা নিজের জায়গা...

এ'রকম একটা জায়গা আছে বদনামের... সারা ঘরে রঙের গন্ধ,কবিতার বই, ইজেল, খালি -আধখালি ক্যানভাস, একটা একফালি খাট, খাটের পাশে পরপর রাখা সদ্য-পুরোনো-বেশ পুরোনো  ছবিগুলো...
আরও অনেককিছুই আছে, সেসব সবাই দেখতে পাবেনা...

আজ, বদনামের এই ঘরটায় শেষদুপুর... সবে বর্ষা ঢুকেছে... প্রথম বৃষ্টির পর থেকে আজ তৃতীয় দিন...

বেনামীর জামার সবুজ - আধভেজা, দরজার পাল্লায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল খুলছে বেনামী...
বদনাম তখন আধশোয়া হয়ে, জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে...বালিশের তলায় ভাঁজ করে রাখা কী যেন একটা কাগজ...
চুপ...
মেঘ ডাকছে ভীষণ..
বেনামী  রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান ধরল -অন্তরা থেকে...
ইশারায় একবার জিজ্ঞেস  করল... কী হয়েছে...

উত্তর নেই...

বদনাম...  ওর পাশে রাখা ক্যানভাসটা নিয়ে এলোমেলো রঙ চাপাতে থাকে...
গান থামায় বেনামী...

বদনামের বাঁ পাশের কাঠের টুলে বসে বেনামী চুপ করে দেখে... ধূসর ঘেঁষে ক্যানভাসে পড়ছে নীল...
নীলের ধারে ম্যাজেন্টা -বোগেনভিলিয়া...
তারপর বৃষ্টি-ভেজা আলো-আলো -হলুদ ছড়াতে ছড়াতে মিশছে কালোয়...
বেনামীর ভালোলাগে...

 যে ক'টা মনখারাপী -কথা ছিল...সেগুলো আজ থাক...

এবার চুপ করে থাকতে ভালোলাগে বেনামীর...

"কী রে!  আমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই তোর"- অস্থিরতা বাড়ে বদনামের তুলিতে...

আলতো হাসে বেনামী...
তারপর হেঁটে যায় কাছে...
বদনামের পাশে রেখে দেয় কীসের  যেন সব কাগজ...
-" ছ'মাসের প্রতিটা এন্ট্রি,  তারিখ অনুযায়ী পরপর আছে রে"- ভীষণ চেনা স্বর, তবু আবার অবাক করে বেনামী...

বদনাম  বালিশের তলা থেকে বার করে  কাগজের অফিসের চিঠি আর একটা টাকার খাম...
"কেমন  যেন একটা লাগছে কাল থেকে" -বদনামের অস্থিরতা একটু ধীর হয়...

" অ্যাকাউন্টে রাখিস.. তারপর আরও কেমন যেন একটা লাগবে!"- বেনামী হালকা করতে চায়  ভার...

"একটা ইলাস্ট্রেশনও না... একটাও দেখতে চায়নি মা " - বদনামের গলা কেঁপে যায়...

বেনামী দু'হাতের ভেতর টেনে নেয়  ওর হাত...
বদনাম ভেঙে পড়ে...

বেনামী ওকে জড়িয়ে নেয় ওতপ্রোত...
বৃষ্টিভেজা,  শান্ত  বেনামী  ছুঁয়ে থাকে ওর সমস্ত ব্যথা...
কান্নায় কাঁপতে থাকা বদনাম...  আস্তে আস্তে স্থির হয়...
হালকা লাগে...
বেনামীর বুকে টেনে- নেওয়া এই শান্তির ভেতর একটা সুন্দর ঘুম আসে...

সেই শান্তির ভেতর মনে পড়ে অনেক কথা...
... সেই সমস্ত কথা যা এই ঘরের ভেতর আড়াল করে রেখেছে বদনাম- সেই সমস্ত মনখারাপ- আজকের  মতোই বা আজকের থেকেও বেশী...
 সেই সমস্ত না পাওয়া... ফিরিয়ে দেওয়া -ফেলে দেওয়া সব...অভিমান... রাগ...  লজ্জা...

খাটের পাশের টেবিলের ড্রয়ারে... খাটের পাশে রাখা ওই পোড়া ক্যানভাসে... দিদুনের তৈরী করা পাশবালিশটায়... জীবনানন্দ  কাব্যসমগ্রের ভেতর...ছোটবেলার আঁকার  খাতায়... কবিতা লেখার ডায়রিতে... ছোট আলমারিতে রাখা পেতলের ওই বাক্সটায় -যাতে রাখা আছে স্কুলের ব্যাজ, ফিজিক্স স্যারের হাতের লেখায় -"চরৈবেতি", মামাবাড়ি থেকে লুকিয়ে আনা নিজের ঝিনুক-বাটি আর আরও অনেককিছু...
এই সবের ভেতর গোপনে রাখা সেই সব কথা.. সেই সমস্ত সত্যি...
যা এই ঘরে বসেই বেনামীকে বলেছে বদনাম... বেনামীর কাছে...  বেনামীর সঙ্গে, কেঁদেছে -হেসেছে...

এই সব কথার ভেতরে বেনামীর মুখটা মনে পড়ে...
মনে পড়ে কীভাবে চুপটি  করে থাকা মেয়েটা এই ঘরে বসে ভীষণ হেসেছে,  কথা বলেছে অনর্গল,  কেঁদেছে অঝোরে...  বেঁধেছে গান -একের পর এক...

কীভাবে বুঝেছে..? কীভাবে সামলেছে ওরা দু'জন...?

ওদের ঘিরে থাকা ঘরটা... আরেকটু ঘন হয়ে আসে ওদের চারপাশে....


...চোখের জল শুকিয়েছে ততক্ষণে...
মাথা তুলে বেনামীর দিকে তাকাতে হেসে ফেলে দু'জনেই...

"আজ থাক,  অন্যদিন "- মনকে আরেকবার শাসন করে বেনামী...

চুপ...

বেনামীকে এবার কাছে বেঁধে নেয় বদনাম...
ছুঁয়ে দেয় ঠোঁট...

নি:শব্দ দৃষ্টি বিনিময়... স্পর্শ...

" জোর করে ভিজে ভিজে এলি কেন?" -বদনামের হাতে ,  বেনামীর যত্ন করে গোটানো, গাঢ় নীল ছাতাটা...

প্রতিটা বাড়িতে, প্রতিটা মানুষের  একটা নিজস্ব ঘর থাকে...
যেখানে নিজের সমস্তটা নিয়ে... নিজের সমস্ত সত্যিটা নিয়ে বাস করা যায়...
যেখানে বলতে হয়না, বলে বোঝাতে হয় না...

তেমনি, প্রতিটা মানুষের একজন নিজস্ব মানুষ থাকে...
একটা নিজস্ব্ জায়গা...

বৃষ্টি পড়ছে... আবছায়া চারপাশে নিবিড় হয়ে আসছে অনুভূতি...

ওরা উত্তর পায়না... ওরা একের অপরকে আকাশ দিল না আড়াল...?

Sunday, June 10, 2018

সরলরেখা : দু'জন এবং... :৮

নিদ্রামগ্ন হওয়ার মতোই মারাত্মক ভাবে যে জলমগ্ন  হওয়া যায় তা এই শহর খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়ায় খামতি রাখেনা...
এক-কোমর জল, হাঁটু ছোঁয়া জল, পায়ের পাতা ভেজানো জল, জল-জল...  সমস্ত  রকমফেরই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাজানো আছে ; কোনোটা এই গলিতে তো কোনোটা ওই রাস্তায়,  কোনো কোনোটা আবার আন্ডারপাসে, কোনোটা বড়রাস্তায়...

সেই জলে ভাসাভাসি করে ভালো -খারাপ সবই...
তবে, সহজে ভেসে যায়না কিছু,এই লাইফ-ইনশিওরেন্স-বিশ্বাসী শহরে জমে থাকেই বেশী...
অটো ঘুরপথে ঘুরে ঘুরে পৌঁছায়,রিক্সার ভাড়া বাড়ে দুদ্দাড়িয়ে, দু'চাকা -চার চাকা বুক জলে দাঁড়িয়ে দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলে...কিছু জামা বারান্দার তারে অসতর্ক-ভেজে বারবার আর বাকিরা আধভেজা হয়ে  মুখগোমড়া করে থাকে ঘরের ভেতর...

পরিপাটি শহর... জলে ভিজে, স্যাঁতস্যাতে শার্ট পরে,  মোবাইল -ল্যাপটপ সামলাতে সামলাতে অফিসে ছোটে, জলে মিশে ট্র্যাফিক লাইট, শপিং মল, বাস-ট্যাক্সি-ট্রাম সব একরঙা হয়ে গিয়ে কেমন যেন অগোছালো হয়ে যায়...
জলের ভেতর দিয়ে সাবধানী চলাচলের গায়ে ছিটকে আসে চাকার নীচ থেকে পিছলে আসা জল!

খবরের কাগজের শিরোনাম বলে ' টানা তিনদিন চলবে ভারী বর্ষণ, শহরবাসীদের দুর্ভোগ'...

 দেখে হাসি পায় বেনামীর - "বর্ষাকাল, ভয় পায় নাকি কেউ!"
"ঠিক বলেছিস!! ছাতা-টাতা সব জলাঞ্জলি দিয়ে বৃষ্টি মাথায় বুক চিতিয়ে বেরিয়ে পড়া উচিত"- চোরা ঠাট্টা মিশিয়ে বিপক্ষের গোলকিপিং করতে থাকে বদনাম...

টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরুর থেকেই তর্ক চলছে...
"এই এক্ষুণি জোরে শুরু হয়ে যাবে রে" -দ্রুত পা চালায় বদনাম...
"আমরা তো সব নুনের পুতুল... না রে!"- যুক্তি দিতে দিতে তাল মেলাতে হুড়োহুড়ি করে বেনামী...
"কারও কাছে ছাতা নেই কিন্তু "- বেনামীর হাত ধরে একটানে সরিয়ে আনে বদনাম...
সঙ্গে সঙ্গে ঝেঁপে বৃষ্টি...

ঝুলবারান্দার নীচের ছাউনিতে দাঁড়িয়ে, বেনামী তখন একেবারে চুপ...
মুখে  এসে লাগছে বৃষ্টির ছাঁট...

বদনাম দেখে... ঝরতে থাকা আকাশটার দিকে তাকিয়ে আছে বেনামী, ওর চশমার কাচে জলের বিন্দু...
তারপর বাঁ হাতে চশমা খুলে মুখটা এগিয়ে দিয়েছে বৃষ্টিতে...
বেনামী হাসছে...  তবু মাঝে মাঝে যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর ঠোঁট দুটো...

বদনাম... অপলক...

আলতো উঠে আসে বেনামীর ডান হাত...খুঁজতে থাকে কী যেন....
ওর হাতটা ছুঁয়ে দেয় বদনাম...
বেনামী আঁকড়ে ধরে...

বৃষ্টি বাড়তে থাকে...

পিঠ বাঁচানো লোকেরা সব মাথা, চটি বাঁচিয়ে দুদ্দাড় দৌড়ে এতক্ষণে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে হয়তো...
রাস্তা খালি...
রোয়াকের লাল মেঝে শুধু বেবাক ভিজছে...

ঘরের ভেতরে চুপচাপ বসে বৃষ্টি দেখা বদনামের বেশী প্রিয়...
বৃষ্টি আর কবিতা...  আর ছোটবেলার মতো... আঁকার খাতায় জলরঙ...

বেনামী চায় বৃষ্টি ভিজতে...

তর্ক হয় দু'জনের...

বদনাম অবাক হয়ে দেখে... শান্ত মেয়েটা বৃষ্টি পড়লে কেমন  এলোমেলো হয়ে যায়... কী অদ্ভুত চঞ্চল!

আর বদনাম নিজে!
ক্রমাগত শান্ত, আরও শান্ত.... ভেতরের ভবঘুরে মানুষটাকে এভাবে ঘরকুনো হতে দেখে , ও নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারেনা....

বদনাম.... শুধু দেখতে থাকে বেনামীকে...
ওর হাতটা মুঠোর মধ্যে নিয়ে আড়াল থেকে যতটুকু বৃষ্টি পাওয়া যায় ততটুকুতেই ভিজছে বেনামী...
ওর থেকে আরও একটু ভেতর দিকে দাঁড়িয়ে বদনাম... বৃষ্টি পাচ্ছে না...
আর্দ্র-শীতল চারপাশ...স্বভাব-টানেই ও ভেতরদিকে গুটিয়ে যাচ্ছে...  একটু একটু করে...
কিন্তু ওর হাত ছুঁয়ে থাকা বেনামীর হাতের ওই উষ্ণতা আজ ওকে কী যেন একটা বলছে....বেনামীর গলায় শোনা লালন ফকিরের ওই গানটা বারবার কানে বাজছে...
কেমন যেন একটা আলগা হওয়ার ডাক... একটা ভেসে যাওয়ার অনুভূতি...

বেনামী তখনও লক্ষ্য করেনি...এই অঝোর বৃষ্টি সামনে নিয়ে ও এতটা চুপ করে আছে কী করে! কী করে এখনও আড়ালের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে ও!কেমন যেন একটা ভেতরদিকের টান,  একটা থিতিয়ে পড়ার মতো অনুভব... বদনামের গোধূলি-মাখা ঘরটা মনে পড়ে ওর...
বারবার...


ভীষণ জোরে একটা বাজ পড়ে...
হালকা গোলাপী আলোয় চোখাচোখি হয়ে যায় দু'জনের...

বদনামের হাতটা মুঠোয় ধরে, আরও একটু কাছে টেনে, বারান্দার আরও একটু ভেতরে দিকে সরে যায় বেনামী...
বৃষ্টি-শহরের নিবিড় আলো চোখে মেখে ওরা খানিকক্ষণ চুপ....

বদনামের হাতের পাতা আঙুলে আঁকড়ে নিয়ে... নিজের বুকের ওপর রাখে বেনামী....

..... স্মৃতি ওলটপালট করে তখন শান্ত হয়ে যাচ্ছে অনেক অস্থিরতা... মৃদু হয়ে যাচ্ছে অনেক চিৎকার...  অনেক কথা....


বদনাম... বেনামীকে একবার  নাম ধরে ডাকে...
তারপর বেনামীর হাত ধরে দৌড়ে  নামে রাস্তায়....
অক্লান্ত, অঝোর বৃষ্টির নীচে ভিজে যায় দু'জনেই.... আপাদমস্তক...

বৃষ্টি আরও বাড়ে...
ভীষণ বৃষ্টির নীচে দাঁড়িয়ে  ওরা  হাসছে ...  দু'জনে...

বেনামী ভাবে - বদনাম ওর ঘর না ভাঙচুর...?

Sunday, June 3, 2018

সরলরেখাঃ দু'জন এবং... :৭

... সমুদ্রের তীর...
যেখানে একটু একটু করে মাটি শেষ হয়ে মিশে যাচ্ছে জলে...
ফুরিয়ে যাচ্ছে দেশ,দেশভাগ...

যেখানে বসে সামনে তাকালে শুধু অথৈ জল... অথৈ গভীরতা...
অপার সমুদ্র যেখান থেকে এগিয়ে যেতে যেতে  মিশে যায় দিগন্তে...

যে সমুদ্রতীর বুক পেতে নিতে  থাকে সব ঢেউ...

একটু একটু করে ভেঙে যায় রোজ... একটু একটু  করে গড়ে ওঠে রোজ....

 সাক্ষী  থাকে...
অসংখ্য সমুদ্রযাত্রা... অসংখ্য নৌকাডুবির...

আর... প্রতিটা সৌরদিনের...


সের'মই একটা সমুদ্রতীরে বসে আছে বদনাম...
সূর্য  ডুবছে দূরে...
ভীড় নেই.. গাঢ় লাল সূর্য-ঘেরা সোনালী তেজ মৃদু হয়ে মিশে যাচ্ছে নোনাজলে...
ভেজা বালির ওপর পা রেখে বসে আছে বদনাম...চুপচাপ...
ফোনে নেটওয়ার্ক নেই...  বেনামীর সঙ্গে কথা হয়নি সকাল থেকে...

একটু দূরে একদল লোকজন...  কাচের বোতলের শব্দ আর অস্পষ্ট হইহই মাঝেমাঝে বাড়ছে...

মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ফিরতি পথের পাখি, একটা -দুটো...

... এইখানে এই আর্ট এক্সিবিশনে সুযোগ পেয়ে ওর আনন্দ হওয়ার আগে কান্না পেয়েছিল...
আর বেনামী...  একদম ওর স্বভাববিরুদ্ধ হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল- "এই তো সবে শুরু! "

- বালির ওপর ছোটদের মতো আঁকিবুকি কাটতে কাটতে এসব কথা এলোমেলো মনে পড়ছিল...

বেনামীর সাথে ওর এই এক বিচ্ছিরি মিল...
নির্জনতা ভালোলাগা... নির্জনতা খুঁজে নিতে পারা...
আর এইরকম চুপচাপ বসে হাসা-কাঁদা-ভাবা...

... গ্যালারীর উজ্জ্বল আলোয় ওর কাজগুলো একটা একটা করে মনে পড়ে বদনামের...
বুকপকেট থেকে ওর ছোট্ট নোটবুকটা বের করে...  এলোমেলো স্কেচের ভেতর এখানেই  ও লিখে রাখে প্রতিটা ছবির গল্প - ভূমিকা..

সন্ধ্যে নামছে... আবছা আলোয় যেন আরও বেশী  জীবন্ত হয়ে  যায় গল্পগুলো...
এখানে ওরা পাঁচটা ছবি পছন্দ করেছে...  যেগুলো এখন গ্যালারির সামনে বাঁদিকে সাজানো পরপর...
এগুলোরও গল্প আছে...

বদনাম খুঁজে নেয়... তারপর স্মৃতির সঙ্গে আরেকবার মিলিয়ে নেয়...

প্রথম ছবিটায় কোনো দাগ নেই... আলোছায়া আর জলরঙ... হালকা আর গাঢ় মিশে মিশে রেখা তৈরী হয়েছে...
বদনাম ছবিটার নাম দিয়েছিল 'ঢেউ',  বেনামীর গলায় প্রথম পূজা পর্যায়ের সেই গানটা শোনার পর আঁকা ওই ছবিটা... বেনামীকে প্রথম কাঁদতে দেখেছিল সেদিন...

দ্বিতীয় ছবিটা তেলরঙে...পানা পুকুর ভরা শালুক ফুলের ছবি,  কী জানি কেন ছবিটার নাম দিয়েছিল  'ব্লসম'.... সেই যেদিন বিকেলের পড়ন্ত আলোয় বদনাম, বেনামীর বৃষ্টিভেজা পা ছুঁয়েছিল,  সেদিন সন্ধ্যেয় ফিরেই ক্যানভাসটায় রং দিয়েছিল ও...

পরের দুটো ছবিই কলকাতা শহরের... মিক্সড মিডিয়া... ঠিক শহরটার মতোই...
বদনাম ...  এই সিরিজটার নাম দিয়েছিল 'বাড়ি'... বেনামী
প্রতিটা ছবির জন্য গান লিখেছিল... আর সেই গান শুনতে শুনতে ছবিগুলো শেষ হয়েছিল রাত জেগে...

পাঁচ নম্বর ছবিটা ওয়াশে করা... বদনাম নাম দিয়েছিল 'আলো', একটা মেয়ের পিঠে ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুলের ছবি...
বদনাম যেদিন প্রথম বেনামীর বুকে মাথা রেখেছিল ছবিটা তার পরদিন ভোরে শুরু করা...

....বদনাম বুঝতেই পারেনি কখন ওর চোখে জল এসেছে...

পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আরও কত গল্প...

সিলেকশনের জন্য যখন ছবি পাঠাতে হবে  তখন বেনামীর সঙ্গে ওর ভীষণ ঝড়-বিদ্যুৎ...তারিখ-তাগাদা সেই সময়ের মতো অধৈর্য ওকে করেনি কোনোদিন... তার ওপর জীবনের সবথেকে বড়ো 'এপ্রিল ফুল' হবার মাসটা, সেই মাসের সঙ্গে মিলে গিয়ে কেমন একটা ভয় পাইয়ে দিচ্ছিল ওকে...
ভীষণ জেদ করে,  খুঁজে খুঁজে পেন অ্যান্ড ইঙ্কের কাজগুলো বার করেছিল,  বেছেছিল 'ড্রাউনড্',  ' অদর্শন' আর 'অভিমান'...মন ভালো ছিল না... বলা  ভালো মন খারাপ ছিল...

জমা দেওয়ার দিনের আগের রাতে... ফোনের ওপাশে বেনামীর গলা...
- " একটাও রঙের কাজ দিবি না ঠিক করেছিস তো ?... "


'অভিমান'-টা সরিয়ে রেখে বদনাম পাঠিয়েছিল জলরঙের কাজ 'বৃষ্টি'....

....নোটবুকটা বন্ধ করে বদনাম আবার বুকপকেটে রাখে...
বেনামীকে দেখতে ইচ্ছে করে খুব...

ঠিক ওই সময়ে দু'বার কেঁপে ওঠে হাতের মুঠোর ফোনটা...
...মেসেজ বক্সে বেনামীর হাসি- "আজ পূর্ণিমা রে..."

.... সমুদ্রে এসে ভিজিয়ে দেয় পা...

বদনাম  ভাবতে থাক ওর জীবন বেনামীর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে না বেনামীর জীবন ওর সঙ্গে...?