প্রতিটা বাড়িতে, প্রতিটা মানুষের একটা নিজস্ব ঘর থাকে; চারদেওয়ালে আটকানো নয়,তবে চারদেওয়ালের চেয়েও বেশী নিভৃত... একটা নিজের জায়গা...
একটা ছোট বারান্দা বা একটা ভাঙা আলমারি, একটা চৌকির তলা বা একটা কাঠের বাক্স, একটা সিঁড়ির কোণ, হয়তো বা পেয়ারা গাছের তলায় বাগানের একটুকরো, কিংবা ওই একখানা বক্স জানলা.... একটা নিজের জায়গা...
যেখানে সবথেকে ভালো ঘুম আসে, যেখানটায় এসে পড়ে সবথেকে মিঠে রোদ্দুর, যেখানে সবচেয়ে কাছ থেকে পাওয়া যায় মায়ের আঁচলের গন্ধ আর সবচেয়ে স্পষ্ট শোনা যায় দিদার সেলাইমেশিনের শব্দ, যে জায়গাটা থেকে দেখা যায় শব্দছকের সমাধান করতে করতে একটু-একটু হাসছে দাদু আর দাড়ি কামাতে কামাতে বাবা গাইছে কিশোরকুমারের গান...
একটা নিজের জায়গা...
যেখানে খানিকক্ষণ এক্কেবারে চুপ করে বসা যায়... লিখে রাখা যায় যা যা মনে আসছে... গাওয়া যায় সুর-নড়বড়ে সবেমাত্র তোলা গানটা...লুকিয়ে রাখা যায় গোলাপী চিরকুট, আঁকার খাতা...ছোটবেলার ঘুঙুর... মোমরঙের টুকরো রাখা যায় যত্ন করে...
যেখানে বসে কাঁদলে দেখতে পায়না কেউ...যার পাশেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জানলাটা...
সেখানে... একটা নিজের জায়গা...
এ'রকম একটা জায়গা আছে বদনামের... সারা ঘরে রঙের গন্ধ,কবিতার বই, ইজেল, খালি -আধখালি ক্যানভাস, একটা একফালি খাট, খাটের পাশে পরপর রাখা সদ্য-পুরোনো-বেশ পুরোনো ছবিগুলো...
আরও অনেককিছুই আছে, সেসব সবাই দেখতে পাবেনা...
আজ, বদনামের এই ঘরটায় শেষদুপুর... সবে বর্ষা ঢুকেছে... প্রথম বৃষ্টির পর থেকে আজ তৃতীয় দিন...
বেনামীর জামার সবুজ - আধভেজা, দরজার পাল্লায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল খুলছে বেনামী...
বদনাম তখন আধশোয়া হয়ে, জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে...বালিশের তলায় ভাঁজ করে রাখা কী যেন একটা কাগজ...
চুপ...
মেঘ ডাকছে ভীষণ..
বেনামী রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান ধরল -অন্তরা থেকে...
ইশারায় একবার জিজ্ঞেস করল... কী হয়েছে...
উত্তর নেই...
বদনাম... ওর পাশে রাখা ক্যানভাসটা নিয়ে এলোমেলো রঙ চাপাতে থাকে...
গান থামায় বেনামী...
বদনামের বাঁ পাশের কাঠের টুলে বসে বেনামী চুপ করে দেখে... ধূসর ঘেঁষে ক্যানভাসে পড়ছে নীল...
নীলের ধারে ম্যাজেন্টা -বোগেনভিলিয়া...
তারপর বৃষ্টি-ভেজা আলো-আলো -হলুদ ছড়াতে ছড়াতে মিশছে কালোয়...
বেনামীর ভালোলাগে...
যে ক'টা মনখারাপী -কথা ছিল...সেগুলো আজ থাক...
এবার চুপ করে থাকতে ভালোলাগে বেনামীর...
"কী রে! আমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই তোর"- অস্থিরতা বাড়ে বদনামের তুলিতে...
আলতো হাসে বেনামী...
তারপর হেঁটে যায় কাছে...
বদনামের পাশে রেখে দেয় কীসের যেন সব কাগজ...
-" ছ'মাসের প্রতিটা এন্ট্রি, তারিখ অনুযায়ী পরপর আছে রে"- ভীষণ চেনা স্বর, তবু আবার অবাক করে বেনামী...
বদনাম বালিশের তলা থেকে বার করে কাগজের অফিসের চিঠি আর একটা টাকার খাম...
"কেমন যেন একটা লাগছে কাল থেকে" -বদনামের অস্থিরতা একটু ধীর হয়...
" অ্যাকাউন্টে রাখিস.. তারপর আরও কেমন যেন একটা লাগবে!"- বেনামী হালকা করতে চায় ভার...
"একটা ইলাস্ট্রেশনও না... একটাও দেখতে চায়নি মা " - বদনামের গলা কেঁপে যায়...
বেনামী দু'হাতের ভেতর টেনে নেয় ওর হাত...
বদনাম ভেঙে পড়ে...
বেনামী ওকে জড়িয়ে নেয় ওতপ্রোত...
বৃষ্টিভেজা, শান্ত বেনামী ছুঁয়ে থাকে ওর সমস্ত ব্যথা...
কান্নায় কাঁপতে থাকা বদনাম... আস্তে আস্তে স্থির হয়...
হালকা লাগে...
বেনামীর বুকে টেনে- নেওয়া এই শান্তির ভেতর একটা সুন্দর ঘুম আসে...
সেই শান্তির ভেতর মনে পড়ে অনেক কথা...
... সেই সমস্ত কথা যা এই ঘরের ভেতর আড়াল করে রেখেছে বদনাম- সেই সমস্ত মনখারাপ- আজকের মতোই বা আজকের থেকেও বেশী...
সেই সমস্ত না পাওয়া... ফিরিয়ে দেওয়া -ফেলে দেওয়া সব...অভিমান... রাগ... লজ্জা...
খাটের পাশের টেবিলের ড্রয়ারে... খাটের পাশে রাখা ওই পোড়া ক্যানভাসে... দিদুনের তৈরী করা পাশবালিশটায়... জীবনানন্দ কাব্যসমগ্রের ভেতর...ছোটবেলার আঁকার খাতায়... কবিতা লেখার ডায়রিতে... ছোট আলমারিতে রাখা পেতলের ওই বাক্সটায় -যাতে রাখা আছে স্কুলের ব্যাজ, ফিজিক্স স্যারের হাতের লেখায় -"চরৈবেতি", মামাবাড়ি থেকে লুকিয়ে আনা নিজের ঝিনুক-বাটি আর আরও অনেককিছু...
এই সবের ভেতর গোপনে রাখা সেই সব কথা.. সেই সমস্ত সত্যি...
যা এই ঘরে বসেই বেনামীকে বলেছে বদনাম... বেনামীর কাছে... বেনামীর সঙ্গে, কেঁদেছে -হেসেছে...
এই সব কথার ভেতরে বেনামীর মুখটা মনে পড়ে...
মনে পড়ে কীভাবে চুপটি করে থাকা মেয়েটা এই ঘরে বসে ভীষণ হেসেছে, কথা বলেছে অনর্গল, কেঁদেছে অঝোরে... বেঁধেছে গান -একের পর এক...
কীভাবে বুঝেছে..? কীভাবে সামলেছে ওরা দু'জন...?
ওদের ঘিরে থাকা ঘরটা... আরেকটু ঘন হয়ে আসে ওদের চারপাশে....
...চোখের জল শুকিয়েছে ততক্ষণে...
মাথা তুলে বেনামীর দিকে তাকাতে হেসে ফেলে দু'জনেই...
"আজ থাক, অন্যদিন "- মনকে আরেকবার শাসন করে বেনামী...
চুপ...
বেনামীকে এবার কাছে বেঁধে নেয় বদনাম...
ছুঁয়ে দেয় ঠোঁট...
নি:শব্দ দৃষ্টি বিনিময়... স্পর্শ...
" জোর করে ভিজে ভিজে এলি কেন?" -বদনামের হাতে , বেনামীর যত্ন করে গোটানো, গাঢ় নীল ছাতাটা...
প্রতিটা বাড়িতে, প্রতিটা মানুষের একটা নিজস্ব ঘর থাকে...
যেখানে নিজের সমস্তটা নিয়ে... নিজের সমস্ত সত্যিটা নিয়ে বাস করা যায়...
যেখানে বলতে হয়না, বলে বোঝাতে হয় না...
তেমনি, প্রতিটা মানুষের একজন নিজস্ব মানুষ থাকে...
একটা নিজস্ব্ জায়গা...
বৃষ্টি পড়ছে... আবছায়া চারপাশে নিবিড় হয়ে আসছে অনুভূতি...
ওরা উত্তর পায়না... ওরা একের অপরকে আকাশ দিল না আড়াল...?
একটা ছোট বারান্দা বা একটা ভাঙা আলমারি, একটা চৌকির তলা বা একটা কাঠের বাক্স, একটা সিঁড়ির কোণ, হয়তো বা পেয়ারা গাছের তলায় বাগানের একটুকরো, কিংবা ওই একখানা বক্স জানলা.... একটা নিজের জায়গা...
যেখানে সবথেকে ভালো ঘুম আসে, যেখানটায় এসে পড়ে সবথেকে মিঠে রোদ্দুর, যেখানে সবচেয়ে কাছ থেকে পাওয়া যায় মায়ের আঁচলের গন্ধ আর সবচেয়ে স্পষ্ট শোনা যায় দিদার সেলাইমেশিনের শব্দ, যে জায়গাটা থেকে দেখা যায় শব্দছকের সমাধান করতে করতে একটু-একটু হাসছে দাদু আর দাড়ি কামাতে কামাতে বাবা গাইছে কিশোরকুমারের গান...
একটা নিজের জায়গা...
যেখানে খানিকক্ষণ এক্কেবারে চুপ করে বসা যায়... লিখে রাখা যায় যা যা মনে আসছে... গাওয়া যায় সুর-নড়বড়ে সবেমাত্র তোলা গানটা...লুকিয়ে রাখা যায় গোলাপী চিরকুট, আঁকার খাতা...ছোটবেলার ঘুঙুর... মোমরঙের টুকরো রাখা যায় যত্ন করে...
যেখানে বসে কাঁদলে দেখতে পায়না কেউ...যার পাশেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জানলাটা...
সেখানে... একটা নিজের জায়গা...
এ'রকম একটা জায়গা আছে বদনামের... সারা ঘরে রঙের গন্ধ,কবিতার বই, ইজেল, খালি -আধখালি ক্যানভাস, একটা একফালি খাট, খাটের পাশে পরপর রাখা সদ্য-পুরোনো-বেশ পুরোনো ছবিগুলো...
আরও অনেককিছুই আছে, সেসব সবাই দেখতে পাবেনা...
আজ, বদনামের এই ঘরটায় শেষদুপুর... সবে বর্ষা ঢুকেছে... প্রথম বৃষ্টির পর থেকে আজ তৃতীয় দিন...
বেনামীর জামার সবুজ - আধভেজা, দরজার পাল্লায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল খুলছে বেনামী...
বদনাম তখন আধশোয়া হয়ে, জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে...বালিশের তলায় ভাঁজ করে রাখা কী যেন একটা কাগজ...
চুপ...
মেঘ ডাকছে ভীষণ..
বেনামী রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান ধরল -অন্তরা থেকে...
ইশারায় একবার জিজ্ঞেস করল... কী হয়েছে...
উত্তর নেই...
বদনাম... ওর পাশে রাখা ক্যানভাসটা নিয়ে এলোমেলো রঙ চাপাতে থাকে...
গান থামায় বেনামী...
বদনামের বাঁ পাশের কাঠের টুলে বসে বেনামী চুপ করে দেখে... ধূসর ঘেঁষে ক্যানভাসে পড়ছে নীল...
নীলের ধারে ম্যাজেন্টা -বোগেনভিলিয়া...
তারপর বৃষ্টি-ভেজা আলো-আলো -হলুদ ছড়াতে ছড়াতে মিশছে কালোয়...
বেনামীর ভালোলাগে...
যে ক'টা মনখারাপী -কথা ছিল...সেগুলো আজ থাক...
এবার চুপ করে থাকতে ভালোলাগে বেনামীর...
"কী রে! আমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই তোর"- অস্থিরতা বাড়ে বদনামের তুলিতে...
আলতো হাসে বেনামী...
তারপর হেঁটে যায় কাছে...
বদনামের পাশে রেখে দেয় কীসের যেন সব কাগজ...
-" ছ'মাসের প্রতিটা এন্ট্রি, তারিখ অনুযায়ী পরপর আছে রে"- ভীষণ চেনা স্বর, তবু আবার অবাক করে বেনামী...
বদনাম বালিশের তলা থেকে বার করে কাগজের অফিসের চিঠি আর একটা টাকার খাম...
"কেমন যেন একটা লাগছে কাল থেকে" -বদনামের অস্থিরতা একটু ধীর হয়...
" অ্যাকাউন্টে রাখিস.. তারপর আরও কেমন যেন একটা লাগবে!"- বেনামী হালকা করতে চায় ভার...
"একটা ইলাস্ট্রেশনও না... একটাও দেখতে চায়নি মা " - বদনামের গলা কেঁপে যায়...
বেনামী দু'হাতের ভেতর টেনে নেয় ওর হাত...
বদনাম ভেঙে পড়ে...
বেনামী ওকে জড়িয়ে নেয় ওতপ্রোত...
বৃষ্টিভেজা, শান্ত বেনামী ছুঁয়ে থাকে ওর সমস্ত ব্যথা...
কান্নায় কাঁপতে থাকা বদনাম... আস্তে আস্তে স্থির হয়...
হালকা লাগে...
বেনামীর বুকে টেনে- নেওয়া এই শান্তির ভেতর একটা সুন্দর ঘুম আসে...
সেই শান্তির ভেতর মনে পড়ে অনেক কথা...
... সেই সমস্ত কথা যা এই ঘরের ভেতর আড়াল করে রেখেছে বদনাম- সেই সমস্ত মনখারাপ- আজকের মতোই বা আজকের থেকেও বেশী...
সেই সমস্ত না পাওয়া... ফিরিয়ে দেওয়া -ফেলে দেওয়া সব...অভিমান... রাগ... লজ্জা...
খাটের পাশের টেবিলের ড্রয়ারে... খাটের পাশে রাখা ওই পোড়া ক্যানভাসে... দিদুনের তৈরী করা পাশবালিশটায়... জীবনানন্দ কাব্যসমগ্রের ভেতর...ছোটবেলার আঁকার খাতায়... কবিতা লেখার ডায়রিতে... ছোট আলমারিতে রাখা পেতলের ওই বাক্সটায় -যাতে রাখা আছে স্কুলের ব্যাজ, ফিজিক্স স্যারের হাতের লেখায় -"চরৈবেতি", মামাবাড়ি থেকে লুকিয়ে আনা নিজের ঝিনুক-বাটি আর আরও অনেককিছু...
এই সবের ভেতর গোপনে রাখা সেই সব কথা.. সেই সমস্ত সত্যি...
যা এই ঘরে বসেই বেনামীকে বলেছে বদনাম... বেনামীর কাছে... বেনামীর সঙ্গে, কেঁদেছে -হেসেছে...
এই সব কথার ভেতরে বেনামীর মুখটা মনে পড়ে...
মনে পড়ে কীভাবে চুপটি করে থাকা মেয়েটা এই ঘরে বসে ভীষণ হেসেছে, কথা বলেছে অনর্গল, কেঁদেছে অঝোরে... বেঁধেছে গান -একের পর এক...
কীভাবে বুঝেছে..? কীভাবে সামলেছে ওরা দু'জন...?
ওদের ঘিরে থাকা ঘরটা... আরেকটু ঘন হয়ে আসে ওদের চারপাশে....
...চোখের জল শুকিয়েছে ততক্ষণে...
মাথা তুলে বেনামীর দিকে তাকাতে হেসে ফেলে দু'জনেই...
"আজ থাক, অন্যদিন "- মনকে আরেকবার শাসন করে বেনামী...
চুপ...
বেনামীকে এবার কাছে বেঁধে নেয় বদনাম...
ছুঁয়ে দেয় ঠোঁট...
নি:শব্দ দৃষ্টি বিনিময়... স্পর্শ...
" জোর করে ভিজে ভিজে এলি কেন?" -বদনামের হাতে , বেনামীর যত্ন করে গোটানো, গাঢ় নীল ছাতাটা...
প্রতিটা বাড়িতে, প্রতিটা মানুষের একটা নিজস্ব ঘর থাকে...
যেখানে নিজের সমস্তটা নিয়ে... নিজের সমস্ত সত্যিটা নিয়ে বাস করা যায়...
যেখানে বলতে হয়না, বলে বোঝাতে হয় না...
তেমনি, প্রতিটা মানুষের একজন নিজস্ব মানুষ থাকে...
একটা নিজস্ব্ জায়গা...
বৃষ্টি পড়ছে... আবছায়া চারপাশে নিবিড় হয়ে আসছে অনুভূতি...
ওরা উত্তর পায়না... ওরা একের অপরকে আকাশ দিল না আড়াল...?