...ব্যস্ততার একটা অদ্ভুত চরিত্র আছে,খুঁটিনাটি দেখার ক্ষমতাকে কেমন একটা অবশ করে দেয়, একটা অদ্ভুত স্বয়ংক্রিয়তা; প্রাতঃকৃত্য, প্রাতরাশ আর যাবতীয় প্রাত্যহিকীর ওপর দিয়ে চোখ-কান বন্ধ করে অনর্গল হেঁটে যাওয়া...
যার যেটা রোজনামচা সেটা নির্বিবাদে করে যাওয়া...
...ব্যস্ততার একটা অদ্ভুত চরিত্র আছে,খুঁটিনাটি দেখার ক্ষমতাকে কেমন একটা অবশ করে দেয়; ব্যস্ততা, একদিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে দেয়না, এককথা বেশীক্ষণ ভাবতে দেয়না, এক রাস্তায় বেশীক্ষণ হাঁটতে দেয়না... ক্রমাগত এই বাস থেকে ওই বাস, এই গলি পেরিয়ে ওই গলি, এই জামা বদলে ওই জামা, এই চিন্তা থেকে ওই চিন্তা, এঘর থেকো ওঘর,ওপর -নীচ, ডানদিক-বাঁদিক, চরকিপাক!
ব্যস্ততা, খানিকক্ষণ থামতে দেয়না, অপেক্ষাও করতে দেয়না!
এগোতে থাকা সময়ে তাড়াহুড়োই নাকি স্বাভাবিক!
ব্যস্ততাই এগিয়ে থাকার লক্ষণ!
সকাল -বিকেল সবাই দৌড়াচ্ছে...
বড়-মেজ-সেজ সবাই দৌড়াচ্ছে...
এপাশ-ওপাশ সবাই হাঁসফাঁস... কারণ দৌড়াচ্ছে...
শহরে দৌড়াচ্ছে- গ্রামে দৌড়াচ্ছে..
দেশে দৌড়াচ্ছে -বিদেশে দৌড়াচ্ছে...
বাইরে দৌড়াচ্ছে...
ভেতরেও দৌড়াচ্ছে...
এর'মই একটা দৌড়াদৌড়ির সময় চলছে ক'দিন ধরে...
এদিকের ব্যস্ততা ফুরোলো আর ওদিকে ব্যস্ততা শুরু...
এ'জনের ব্যস্ততার শেষ দু'দিন ও'জনের ব্যস্ততার প্রথম দুই....
একজনের হাতে রঙ তো আরেকজনের মুখে বই...
একজন আর্ট গ্যালারি তো আরেকজন রেকর্ডিং স্টুডিও...
একজন তিনদিনের জন্য পাহাড়ে তো আরেকজন এক সপ্তাহের জন্য দেশের বাড়ি...
ব্যস্ততার উল্টোদিকে হাঁটা ওরা দু'জন কেমন যেন একটা ব্যস্ততার গোলকধাঁধাঁয়...
এই ব্যস্ততার ফাঁকফোকর গলে.... ওদের দেখা হয়েছে এলোমেলো...
কলেজফেরতা ওই পনেরো মিনিটে, যাওয়ার পথে ভিড় মেট্রোয় দু'জনের একজন নেমে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আর এমনই একটু করে কুড়িয়ে-বাঁচিয়ে দেখা হয়েছে ওদের...
... বদনাম যেদিন আলুকাবলি এনেছিল রঙ-কাগজ কিনে ফেরার সময়ে, বেনামী সেদিন ওকে একটিবার দেওয়ারও সুযোগ পেল না,ততক্ষণে বেনামীর লাইব্রেরি যাওয়ার বাস হাজির... আর সেদিন মেট্রো থেকে নামার সময় প্রত্যেকবারে মত সবার চোখের আড়ালে বেনামীর হাত ছুঁতে পারলনা বদনাম, হুড়মুড়িয়ে নামতে যাওয়া একজন মহিলার ওড়না বদনামের ব্যাগে আটকে হ্যাঁচকা টান...
শেষ মাসের ইলাস্ট্রেশন গুলো টেবিলের পেপারওয়েটের নীচে রাখতে রাখতো বেনামী ভাবছিল -বদনাম সেই কবিতাটার লাইনগুলো আবারও বলবে... বদনাম বলেনি, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে জলের বাটি উল্টে থইথই...
বদনামের সেদিন ফিরতে গিয়ে ভীষণ দেরী, মেট্রো খারাপ, বেনামীকে ফিরতে হলো -সাতটা নাগাদ পড়াতে যাওয়া, বেনামীর 'আজ আসি' -শব্দ দুটো মেসেজ বক্সে নিয়ে কিছুতেই ভাল্লাগছিলনা ওর...
তারপর যেদিন গাঢ় নীল শাড়ি-বেনামী ভীষণ হাওয়ায় চুল খুলে, বদনাম একবারও বলল না "বেঁধে নে",অটো থেকে নেমে দৌড়ে টিকিটের লাইনে...
সেদিন বেনামীর চোখে জল চোখে পড়েনি, সেদিন বদনামের আঙুল কেটেছে মূর্তি তৈরীর স্প্যাচুলায় - বেনামী দেখেনি, দেখেনি "বর্ষা"-সিরিজের আঁকাগুলো শেষ হয়েছে...দেখেনি ওর জামার বোতাম ছিঁড়েছে, দেখেনি রাস্তা পার হয়ে যাওয়ার সময়ে বদনাম ওর দিকে তাকিয়ে ছিল সারাক্ষণ...
বদনাম শুনতে পারেনি বেনামীর গান, পড়া হয়ে ওঠেনি নতুন কবিতাগুলো,কাগজের অফিসে যাওয়ার তাড়ায় শোনা হয়নি গল্প, দেখা হয়নি বেনামী দুল পরতে ভুলছে, বাকী থেকেছে কথা...
সেই যেদিন ছাদে বসে থাকতে থাকতে বেনামী ওকে ফোন করছিল... ফোন চাপা পড়েছে বইগুলোর তলায়... কথা বলা হয়নি...
বেনামীও বোঝেনি বদনাম তখন আঁকছে " তারা-রাত", ক্যানভাস জুড়ে তারা ঝিলমিল রাত-আকাশ আর একপাশে দুটো বাড়ি...
ভেজা চোখ নিয়ে ছাদ থেকে নেমে বসতে হয়েছে পড়ায়....
এর'ম অনেকগুলো খাপছাড়া দিন, ভীষণ ব্যস্ততায় দমবন্ধ দিনের পর - ওদের দেখা হয়েছে আজ...
এই ক'দিন ধরে কেমন যেন একটা মনখারাপী ছায়া... কেমন যেন একটা অপছন্দের স্বাদ....
চাইতে গিয়ে না চাইতে পারা, বলতে গিয়ে না বলতে পারা , দেখতে গিয়ে না দেখতে পারা...
হাত ধরে টানতে টানতে কেউ যেন সরিয়ে নিয়ে গেছে প্রতিবার...
ঢেকে দিয়েছে চোখ...
বুকের মধ্যে একদানা বালি নিয়ে আজ দেখা হয়েছে ওদের...
কে কাকে কখন খুঁজেছে, কার চোখে কখন
জল-ছলছল, কার মনে কখন মেঘ-গুড়গুড়, কার কখন ঘুম এসেছে, কখন কীভাবে লেখা থেমেছে, কখন কতটা খারাপ লাগা...
বুঝতে ভুল হয়েছে... বোঝার সময় পায়নি...
হিসেব ভুল হয়েছে... হিসেব করার সময় হয়নি...
সেই সব এলোমেলো হিসেব নিয়ে ওদের আজ দেখা হয়েছে...
কীসের একটা অনভ্যাস যেন...
দু'জনেই চুপ...
চারপাশে একটা সদ্য জাগা ভোর...
ঘাটের শেষ ধাপটায় ওরা দু'জনে পাশাপাশি বসে, জলে পা ডুবিয়ে...
বদনাম দেখছে বেনামীর মুখের ডান পাশে নরম চুলগুলো ঝিরিঝিরি উড়ছে...
বেনামীর মুখ জলের দিকে,তবু ও জানে বদনাম ওর দিকে ফিরে...
... বেনামী পাশ ফিরে তাকায়...
এতদিনের গায়ে লেগে থাকা ধুলোবালি খসতে শুরু করে...
বদনাম বলছে-
" এখন তোমার আকাশ ভরা গান
এখন তোমার দু'পাশে ধানখেত
এখন তুমি টলমল নৌকায়
এখন তুমি ভীষণ আমার মতো
এখন তুমি ঝলমল জ্যোৎস্নায়"
- বেনামী শুনছে... শুধু শুনছে...
বেনামীর নিজের লেখা কবিতার লাইন....ব্যস্ত সময়ে বদনামের মেসেজবক্সে পৌঁছেছিল কোনো একবারের রাতজাগায়....
বদনাম থামে...
বেনামীর মুখে এসে পড়েছে সকালের রোদ্দুর...
বেনামী ব্যাগ থেকে বের করে বদমামের হাতের ওপর রাখে, একগুচ্ছ ফোটোগ্রাফ - প্যানোরমিক ভিউতে পুরো গ্যালারিটা, কাচের ওপাশে বৃষ্টি আর এপাশে "বর্ষা"-সিরিজের পঁচিশ নম্বর ছবি - "আসন্ন"-একটা কোলাপসিবল বারান্দা- একটা জুঁই গাছ-আর মেঘলা আকাশ,একটা তিনফুট বাই পাঁচফুটের ক্যানভাস -কালো পুকুরের জলে বৃষ্টি পড়ছে- সামনে দাঁড়ানো বদনাম-ফোকাস লাইট এসে পড়েছে চশমায়...
বেনামীকে সেদিন চলে যেতে হয়েছিল তাড়াতাড়ি.... তবু...
মুহুর্তগুলো হাতে নিয়ে ... কিছু বলতো পারেনা বদনাম... বেনামীর হাত নেয় হাতের মুঠোয়....
-"বোতাম ছেঁড়া জামাটা আবার পড়েছিস!" - ছন্দে ফেরে বেনামী...
... চোখে চোখ রেখে বেনামীর বেঁধে রাখা চুল খুলে দেয় বদনাম...
.... সকালের রোদ্দুর আরও উজ্জ্বল হচ্ছে চারপাশে...
ওরা বসে আছে পাশাপাশি...
পাশের রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে গাড়ি-মানুষ-ব্যস্ততা...
ওরা বসে আছে পাশাপাশি...
ওরা ভাবছে... সময়ের থেকে ওরা একে অপরকে চেয়েছে... না সময়ের কাছে একে অপরকে পেয়েছে...?
No comments:
Post a Comment