Saturday, May 26, 2018

সরলরেখাঃ দু'জন এবং... : ৬

.... বেলা বাড়ার চোখ রাঙানো রোদ...
তার দিকে একটা ফিচেল হাসি ছুঁড়ে দিয়ে ঝপ করে মাটি-রঙ জলের ভেতর...
লঞ্চের ধার ছুঁয়ে সাঁতরাতে সাঁতরাতে একহাতে ছোঁ মেরে ধরে নেওয়া দড়িতে বাঁধা পুরোনো টায়ার... হুড়মুড়িয়ে এসে পড়া ঢেউ চোখে মুখে মাখতে মাখতে  হু -হু পেরিয়ে যাওয়া অনেকটা জল...
লঞ্চের মাথা থেকে এক নিঃশ্বাসে জলের মধ্যে!
তারপর সবাইকে চমকে দিয়ে আবারও উঠে আসা ...
একটা দুর্দান্ত জিতে যাওয়ার  মুহুর্ত...আর  ওই যুদ্ধ জয়ের হাসি...

"ওদের মরে যাওয়ার ভয় হয়না!"- ওদের দেখতে দেখতে চঞ্চল হচ্ছিল বেনামী...
জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ  আর মাঝদুপুরে জলের থেকে উঠে আসা একটা আর্দ্র উষ্ণতা... ওদের অসময়ের এই দেখা করার সময়টা জুড়ে আরও -আরও এলোমেলো...

বেনামী জলের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে...
ছোট ছোট ঢেউয়ের কপাল ছুঁয়ে রোদ এসে পড়ছে বেনামীর অযত্নে রাখা চুলে...

লঞ্চের রেলিংয়ে পিঠ রেখে.. বেনামীর দিকে তাকিয়ে বদনাম...
বেনামীর গাঢ় বাদামী চোখের ভেতর এক বিন্দু ঘন কালো আছে... সেটাই খুঁজছে হয়তো...
কিছু মনে পড়ছে?

"কী দেখছিস রে? " - দুষ্টু হাসি বেনামীর চোখের কোনায়....
"তোমায়" -বেনামীকে চমকে দিয়ে গাঢ় হয় বদনামের গলার স্বর....
"এ-ই...."- বেনামী বুঝে নিতে চায়...
খানিকক্ষণের নির্বাক দৃষ্টিবিনিময়....
বদনামের চোখের ভেতরে একটা জমাট কান্না আছে...

বেনামী দেখতে পাচ্ছে সেটা নরম হচ্ছে ক্রমশ...

এই মধ্যদিনের চড়া রোদের নীচে,  চোখের জল...
 বেমানান ?

-"ওভাবে কথাটা বলিনি,  তোমায়".... বেনামীর স্বরে অনেকদিনের না আসা বৃষ্টি...

"জানি" - আর বেশী বলতে পারেনা বদনাম...

সত্যি, বেনামী  জানে... ওই সাধারণ শব্দগুলো কেন বদনামকে এতটা আঘাত দিতে পারলো!

সত্যিই ও জানে...  'মরে যাওয়া' কথাটুকু বদনাম কীভাবে সহ্য করে...  আজও...

জানে, বদনামের চোখের সামনে  কীভাবে চলে আসে  সেই ভীষণ শীতের রাত, সেই পোড়া গন্ধ, সেই আগুনের শিখা, সেই অফিস নোটবুকে লেখা সুইসাইড নোট....
জানে,  বদনামের সেই দুঃস্বপ্নগুলো... সেই সমস্ত রাতজাগা কান্না...  রাগ...

জানে, বদনামের হাতে আঁকা ওর দাদার পোর্ট্রেট,  সেই শীতের রাতে কীভাবে ঝলসে গিয়েছিল আগুনে...
জানে, সেই ক্যানভাস... এখনও   রাখা বদনামের বিছানার পাশে...
জানে, মরে যাওয়ার ভয় কেন এত মারাত্মকভাবে বদনামের বুকের ভেতর...
কেন এই অস্থিরতা... কান্না...

"তোকে যেদিন প্রথম দেখলাম...সেদিন আবার তুলি ধরতে পারলাম...  কিছু আঁকতে পারিনি... সারারাত..   শুধু রঙ দিয়ে গেছিলাম ক্যানভাসে..."

বেনামীর ভীষণ ইচ্ছা করল বদনামের হাতটা চেপে ধরে নিজের দু'হাতের ভেতর...আগলে নেয় এই অস্থিরতা...
পারল না... এই ভীড়ের মধ্যে... শুধু তাকিয়ে রইল ওই কান্নার ভেতরে...

.... জলের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ল আরেকটি কিশোর... ছিটকে আসা জল ভিজিয়ে দিলো ওদের দু'জনকেই...

আধভেজা ব্যাগের থেকে ও বার করল একটা ভাঁজ করে রাখা কাগজ...

বদনামের বুক পকেটে রাখতে রাখতে ও বলল- "তিনি লিখেছেন... স্কেচ না  শুধু রঙের কথা..."

 বদনামের মুখে তখন....সেই হাসিটা...

বেনামী  সেই হাসিটা দেখতে দেখতে ভাবতে থাকে - স্বপ্ন প্রেমের মতো না প্রেম স্বপ্নের মতো...

ওদের অজান্তে...  কখন যেন আঙুলে আঙুল ঠেকে গেছে....

Saturday, May 19, 2018

সরলরেখাঃ দু'জন এবং... : ৫


শহরের নাকি মন নেই, গান নেই,  ক্যানভাস নেই...
ট্র্যাফিক আর কংক্রিটে আটক নাকি সব...
l
শহরে নাকি রাগ করলে রোদ হয় না, মনখারাপ হলে মেঘ হয়না, হয়না লুকিয়ে -দেখা কনে দেখা বিকেল- ঘুড়ি ওড়ানো আকাশ... প্রেমে পড়লে কৃষ্ণচূড়ার লাল হয়না....অভিমানের শান্ত দিঘি হয়না... ভেঙে পড়লে বৃষ্টি হয়না...
এমনকী... বিপ্লবী হলে রক্তপাতও হয়না...

শহরের নাকি মন নেই...

শহর ভিখারীকে খাবার দেয়না, উলঙ্গ শিশুকে জামা দেয়না....প্রেমিক-প্রেমিকাকে আগল দেয় না.... বাড়িকে প্রতিবেশী দেয়না... মানুষকে আত্মীয় দেয়না....

শহরের নাকি মন নেই...
গান নেই... কবিতা..  ক্যানভাস নেই....


ওরা দুজন তখন একটা বন্ধ দোকানের ছাউনির তলায় পাশাপাশি...

রাস্তার মোড়ে যে জমায়েতটা হয়েছে তার থেকে বেশ খানিকটা আড়ালে...
ওখানের কোনো লোকই ভাবেনি এর'ম জরুরী সমাবেশ ওলটপালট করে দিয়ে এইরকম একটা ঝড় উঠবে!

মেঘ ডাকা,তুমুল বৃষ্টি... এলোপাথাড়ি উড়তে থাকা -দড়িতে লাগানো সার সার কাগজের দলীয় পতাকা,
নামীদামী গয়নার দোকান আর সুগন্ধীর হোর্ডিং কাঁপিয়ে হাহা করতে থাকা হাওয়া আর  ধোঁয়াধুলোর শহুরে-আকাশ চিরে বিদ্যুৎ...

এসবের মধ্যে ওরা সামলে নিতে চাইছে ওদের নিজেদের ঝড়....

গত তিনদিন ধরে শুধু এলোমেলো কথা, জমাট চুপ করে থাকা, গুমোট বিকেল ওদের মতোই বলতে পারেনি অনেককিছু...

ভীষণ চঞ্চলতা নিয়ে তাই ওরা দেখা করেছিল এই ক্লান্ত সন্ধ্যেয়....

ঝড় ওঠার আগের মুহুর্ত অবধি তর্ক চলেছে, কেউ শুনতে চায়নি কথা, ভাঙতে চেয়েছে যুক্তি...

তারপর এই ওলোটপালট করা ঝড়...
তখন থেকে কথা হয়নি কোনো...
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মনে পড়েছে কথা... অনেক কথা...
মনে পড়েছে দু'জনেই কী অদ্ভুত ভাবে আক্রমণ করেছে একে অপরকে... সেইসব শব্দ... কানে বাজতে থাকা ওই কন্ঠস্বর...
কীভাবে ওরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে একে অন্যের দূর্বলতা -হেরে যাওয়া গুলো....
মনে পড়েছে কীভাবে বোবা হয়ে গেছে দু'জনেই...
মনে পড়েছে ফোনের ওপারে শোনা কান্না,মনে পড়েছে ওরা কীভাবে নিজেদের বিপরীতে গিয়ে আঘাত করেছে একে অপরকে...

আর...  এর সাথে মনে পড়েছে  আরও গোপন...  আড়ালের ব্যথাগুলো... যেগুলো ওরা আগলে রেখেছে আপ্রাণ...
নিজের ব্যথাগুলো ছাপিয়ে আরেকজনের যন্ত্রণাগুলো...


ওদের ঘিরে উন্মত্ত ঝড়...
নিজেদের কথাকাটাকাটি... নীরবতা... কান্না...  দমবন্ধ হয়ে আসা ওই মুহূর্তগুলো... আরও ঝোড়ো হয়েছে ক্রমশ...
মনের মধ্যে হারিয়ে ফেলার একটা ভয় ঘন হয়েছে আরও.... আর সেই ভয়ের ভেতরে বদনাম আর বেনামী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থেকেছে অনেক্ষণ...

বজ্রপাত আর সমাবেশের কর্কশ চিৎকার...
তারই মধ্যে দামাল হাওয়া... তীরের মতো মুখে এসে লাগা বৃষ্টির ছাট... পিচের রাস্তায় অবিশ্রান্ত জল আর সেই জলে পিচ্ছিল হয়ে ওঠা.. গাড়ির লাল-হলুদ আলো...
বিদ্যুতের গাঢ় গোলাপি আভা আর ছুটে যাওয়া আ্যম্বুল্যান্সের আওয়াজ...

ওদের ভেতরের ঝড়... অস্থিরতা.. বেড়েছে ওই ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে...

ওরা... পাশাপাশি দাঁড়িয়ে...

তারপর... সেই যখন ভীষণ জোরে বাজ পড়ল খুব কাছেই...
বদনাম...  বেনামীর হাত শক্ত করে ধরে, তাকিয়ে ছিল চোখে...
বেনামীর চোখে তখন তিরতির করে কাঁপছে জল.. সেই জলে কাঁপছে বৃষ্টি আর বৃষ্টিতে মেশা শহরের আলো...
 কেমন যেন অপরাধী হয়ে যাওয়া দু'হাতে ওকে আরও নিবিড় করে নিয়ে সেই চোখের আরও ভেতরে তাকিয়ে কী যেন খুঁজছিল বদনাম...
অস্ফুটে একবার বলেছিল- ভাল্লাগছেনা...
বেনামী..  আরও কাছে  গিয়ে ঠোঁট রেখেছিল বদনামের ঠোঁটে...
বন্ধ চোখ থেকে তখন নেমে আসছে জল...
ঝড় থামছে...

বদনাম আর বেনামী,  এবার পা ভিজিয়েছে জলে... ওদের বাড়িফেরা ভিজছে বৃষ্টিতে...

ওরা... আবারও কী  চিনল?
মানুষের মন না মনের মানুষ...?

Friday, May 11, 2018

সরলরেখাঃ দু'জন এবং... :৪

আকাশ নরম হয়ে আসে... দুপুরের চড়া রোদ হাইরাইজের মাথার ওপর থেকে নেমে আড়ালে যায়...তারপর গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে... খেলার মাঠে... চা-দোকানের বেঞ্চে থিতিয়ে পড়তে পড়তে...
মিশে  যায় স্কুলফেরত আলুকাবলির শালপাতায়-গঙ্গার ঢেউয়ে আলতো কাঁপতে থাকা শেষবেলার আলোয়...

নরম নীল ব্যাকড্রপে... হালকা গোলাপী...
কখনও উজ্জ্বল  সাদা আর দিগন্তছোঁয়া একটা শীতল কমলা সূর্য...
আবার কখনও... গাঢ় কমলা আকাশ আর রক্তলালে গাঢ়তর...
...বিকেল...
সমস্ত দিনটার...  ভীষণ থেকে নরম হওয়ার সময়... আবারও সন্ধ্যের মতো কঠিন আর নির্বাক হওয়ার আগে অনর্গল কথোপকথনের মতো সময়....


এ'রকমই একটা বিকেলের ভেতর ওরা পাশাপাশি শুয়ে আছে...
ছাদটার ওপর ঝুঁকে পড়েছে বিকেল-মাখা আকাশ... বাঁ-পাশে  ফুল-লাল কৃষ্ণচূড়ার অর্ধেকটুকু দেখা যায়...আর
ওদিকে তিনটে সুপুরি গাছ, হালকা হাওয়ায় এদিক ওদিক;  পিছন দিকে দু'-তিনটে বাড়ি খানিক দূরে - বাড়ি না ফ্ল্যাট... ভাগাভাগির ছাদে লোক দেখা যায়না সচরাচর...শুধু আলাদা আলাদা দড়িতে শুকোতে দেওয়া আলাদা আলাদা তলার কাপড়জামা...

এভাবে পাশাপাশি অনেকক্ষণ আকাশ দেখছে ওরা...
এদিকওদিক  দু'-চারটে ঘুড়ি উড়ছে...
বেনামীর ছোটবেলার কথা মনে পড়ে - বিশ্বকর্মা পুজোর সপ্তাহে বাবা ঘুড়ি ওড়াতো খুব...লাটাই হাতে বাবার  দিকে তাকিয়ে ও দেখত ছোট ছেলের  মতো হাসছে বাবা....  কত অন্যরকম হয়ে যেতো বাবা তখন...
বদনাম তখন আঙুল দিয়ে বেনামীর হাতের পাতায় আাঁকিবুকি কাটতে কাটতে অগোছালো ভাবনা গুলোকে সাজানোর চেষ্টায়...
"অনেকবার চেষ্টা করলাম,  পারছিনা কেন রে?"
বেনামী পাশ ফিরে বদনামের দিকে তাকায়....
"আমিও পারিনি..." বেনামী আবার আকাশের দিকে ফেরে...
"ছটা পেপার জাস্ট নষ্ট করলাম"- বদনাম অধৈর্য...
"আগুন আঁকা যাবে? কান্না... রক্তপাত.. আঁকতে পারবি? "
-বদনামের চোখে চোখ রাখে বেনামী...
-বদনাম তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক...
বেনামীর ঠোঁটটা কাঁপছে...
ওর কাঁধটা চেপে ধরে বদনাম বলে -"কাঁদবি না"...
ভীষণ রাগে এভাবেই কেঁদে ফেলে বেনামী...

- সেই রাতটা মনে পড়ে ওর... ইচ্ছে করে তৈরী করা লোডশেডিং, মাঝারাতে আচমকা ঘরে ঢুকে পড়া কতগুলো লোক... মারধর আর চিৎকার, মায়ের কোলের ভেতর আরও লুকোতে থাকা ও নিজে আর সকাল হতেই দেখতে পাওয়া দেওয়ালে রক্তের ছোপ আর লন্ডভন্ড ভাড়াবাড়ির ঘর...
রঙ-লাগা দু'হাতে বদনাম, বেনামীকে জড়িয়ে নেয়...
ছুঁয়ে দেয় কাঁপতে থাকা বুক... কাঁপতে থাকা ঠোঁট...
ওই দু'হাতের ভেতর বেনামী শান্ত হয়ে আসে...
বদনামের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না,  আলতো হাসে...
সেই দেখতে -চাওয়া হাসিটা আরেকবার ছুঁয়ে নেয় বদনাম....

ও পারবে... পারবেই...
আগুন...  ওকে আঁকতেই হবে....

সামনের আকাশের  সদ্যবিকেলের সেই নরম আলো....
উজ্জ্বল.... আরও উজ্জ্বল হলুদ... তারপর গাঢ় লাল মিশতে মিশতে এলোমেলো...

নিবিড় হতে হতে.... খসে যাচ্ছে সব নীরবতা...
না-পারাগুলোর ভেতরেও এত শক্তি থাকে!

বেনামী ..  তখনও বদনামের দিকে তাকিয়ে....

ওরা ভাবছে... মৃত্যুগুলোকে হারিয়ে দেওয়াটা জয়, না  জয়... বেঁচে থাকা....

Saturday, May 5, 2018

সরলরেখাঃ দু'জন এবং... :৩

এই ব্যতিব্যস্ত শহরে গরমের দুপুরগুলো বড়ো নির্দয়... একেই কারণে-অকারণে সবাই দৌড়াচ্ছে, তার ওপর সুতির জামা-হালকা রঙ-মনে করে ছাতা-রোদচশমা-ইচ্ছে হলে সানস্ক্রিন-ফলের রস এতো কিছুর সতর্কতা আর কাগজ জুড়ে হিটস্ট্রোকের চোখরাঙানি...
ওই ব্যস্ততার এককোণে দাঁড়িয়ে থেকে দেখো... যাবতীয় লোকজনের  সাবধানতা-"সেল্ফ কেয়ার"-অপ্রস্তুতি... এদিকসেদিক...
... কেউ আড়াল করছে চোখ,  কেউ ঢেকে নিচ্ছে স্লিভলেস-হাত, কেউ ঢুকে যাচ্ছে ছায়ায়, কেউ চেয়ে নিচ্ছে আইসক্রিম...
বড়ো রাস্তা-অটোর লাইন -স্কুলগেট-রিক্সা স্ট্যান্ড- খাবার দোকান-সবজি বাজার... ছড়িয়ে থাকা ক্লান্ত-ব্যস্ত-বিরক্ত ভিড়ে... মিশে যাচ্ছে ফুল-ফুল কিশোরী-ছাতা...একরঙা অফিসের ছাতা...  চকচকে সস্তার ছাতা... চিরকেলে গম্ভীর কালো ছাতা... রক্তদান শিবির থেকে দেওয়া এত্তোবড়ো ছাতা... হাতে ফ্রিল বসানো মায়ের ছাতা... কোনা-ছিঁড়ে যাওয়া কাজ-চালানো ছাতা... হলুদের ওপর হাসিমুখ আঁকা ছোটদের ছাতা... আর পাঁচ-ছ'টা ওই একই দেখতে "দামাদামি করবেন না"-ছাতা...

এ'রকমই একটা দুপুর দেখতে দেখতে,  বেনামী এসে দাঁড়ায় মেট্রো স্টেশনের বাইরে...
ফলের রসের দোকানে তখন মাঝ-দুপর ভিড়...
অন্য দিন গুলোয় যেখানে দাঁড়ায় আজও সেখানে, একটা ছোট্ট মেসেজ পাঠায় বদনামকে- "পৌঁছলাম"...
ওদিক থেকে উত্তর আসেনা... কী জানি একটু চঞ্চল হয়েই আরেকটা মেসেজ পাঠায় - " অটোর সামনে তো? সাবধানে আয়..."  
চারদিকে তাকিয়ে  বেনামীর তেমন করে কিছু চোখে পড়ে না, চড়া রোদ  আর চারপাশের অতিরিক্ত হয়ে যাওয়া রঙ গুলো ওর খুব একটা ভালো লাগে না...
গরমের ছুটি শান্ত দুপুরের পাখার আওয়াজ,  আর মায়ের আঁচল থেকে ওই যে রান্নাঘরের গন্ধ - বেনামীর হঠাৎ যেন মনে পড়ে যায়...

সপ্তাহের এই একটা দিনই ওদের কাজ-কলেজ তাড়াতাড়ি থামে... তারপরই একজন মেট্রো...আর একজন বাস... 
... বেনামী ব্যাগের ভেতর, তখন ল্যাবে ফেলে-আসা রুমালটা খুঁজছে...
অটোটা এসে থামতে,  তাকিয়ে দেখে সামনের বাঁদিকের সিট থেকে নামছে বদনাম...
বেনামীর ঠোঁটে তখন অজান্তে-হাসি...
"এই রোদের মধ্যে কেউ দাঁড়ায়! ওই দিকেই তো ছায়া ছিল!" - আর্ট পেপারের রোল গুলো সামলাতে সামলাতে বকুনি দেয় বদনাম...
রোজ যেখানে দাঁড়ায় সেখানেও যে রোদ,  খেয়াল করেনি ছাতা-অপছন্দ বেনামী...
" আমি দাঁড়াই"- দুষ্টু হাসে বেনামী...

পকেট থেকে ছোট্ট নোটবুক বের করে বেনামীকে দেখায় বদনাম....
"তিনমাস বাকি, আর".... "একগাদা কাজ বাকী তাই তো?" -বদনামের কথাটা বলে ফেলে বেনামী...
"প্রথম যে গ্যালারিটা তোকে দেখিয়েছি, ওখানে"-বেনামীর দিকে তাকিয়ে থাকে বদনাম...
"দরজা দিয়ে ঢুকে এগিয়ে  সামনের দেওয়ালে"-বেনামী চোখ সরায় না...

হাঁটতে হাঁটতে ওরা ততক্ষণে গঙ্গার ধার....
জলের ওপর শেষ-দুপুরের গ্রীষ্ম ফুরিয়ে আসছে....

ওরা কথা বলছে না...
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে ছুঁয়ে যাচ্ছে আঙুলে আঙুল...
ওরা পেরিয়ে যাচ্ছে ভোট চেয়ে চেয়ে বিশ্রী দেওয়াল লিখন- গাছতলার মন্দিরে চালানো উৎকট গান- হাত পাতা ভিখারী আর হাত পাততে শেখা তার  বছর আটেকের ছেলেটা...
ঘাটের সিঁড়ি  দিয়ে নেমে ওরা দাঁড়িয়ে থাকে খানিক...
মৃদু হয়ে আসা সূর্যের আলোয় বিকেল শুরু হবে...

"শোন"- আর কিছু বলতে পারেনা বদনাম...
বেনামীর রোদে-পোড়া কপাল...  কপালের টিপ....তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর স্বপ্নগুলো মনে পড়তে থাকে....
বেনামী ওই দৃষ্টিটার দিকে তাকিয়ে থাকে....
ওদের চারপাশে তখন আরেকটা আগুন-বিকেল...

বেনামী ভাবতে থাকে... এটা ভালোবাসা না "ভালোবাসি"...