Saturday, May 5, 2018

সরলরেখাঃ দু'জন এবং... :৩

এই ব্যতিব্যস্ত শহরে গরমের দুপুরগুলো বড়ো নির্দয়... একেই কারণে-অকারণে সবাই দৌড়াচ্ছে, তার ওপর সুতির জামা-হালকা রঙ-মনে করে ছাতা-রোদচশমা-ইচ্ছে হলে সানস্ক্রিন-ফলের রস এতো কিছুর সতর্কতা আর কাগজ জুড়ে হিটস্ট্রোকের চোখরাঙানি...
ওই ব্যস্ততার এককোণে দাঁড়িয়ে থেকে দেখো... যাবতীয় লোকজনের  সাবধানতা-"সেল্ফ কেয়ার"-অপ্রস্তুতি... এদিকসেদিক...
... কেউ আড়াল করছে চোখ,  কেউ ঢেকে নিচ্ছে স্লিভলেস-হাত, কেউ ঢুকে যাচ্ছে ছায়ায়, কেউ চেয়ে নিচ্ছে আইসক্রিম...
বড়ো রাস্তা-অটোর লাইন -স্কুলগেট-রিক্সা স্ট্যান্ড- খাবার দোকান-সবজি বাজার... ছড়িয়ে থাকা ক্লান্ত-ব্যস্ত-বিরক্ত ভিড়ে... মিশে যাচ্ছে ফুল-ফুল কিশোরী-ছাতা...একরঙা অফিসের ছাতা...  চকচকে সস্তার ছাতা... চিরকেলে গম্ভীর কালো ছাতা... রক্তদান শিবির থেকে দেওয়া এত্তোবড়ো ছাতা... হাতে ফ্রিল বসানো মায়ের ছাতা... কোনা-ছিঁড়ে যাওয়া কাজ-চালানো ছাতা... হলুদের ওপর হাসিমুখ আঁকা ছোটদের ছাতা... আর পাঁচ-ছ'টা ওই একই দেখতে "দামাদামি করবেন না"-ছাতা...

এ'রকমই একটা দুপুর দেখতে দেখতে,  বেনামী এসে দাঁড়ায় মেট্রো স্টেশনের বাইরে...
ফলের রসের দোকানে তখন মাঝ-দুপর ভিড়...
অন্য দিন গুলোয় যেখানে দাঁড়ায় আজও সেখানে, একটা ছোট্ট মেসেজ পাঠায় বদনামকে- "পৌঁছলাম"...
ওদিক থেকে উত্তর আসেনা... কী জানি একটু চঞ্চল হয়েই আরেকটা মেসেজ পাঠায় - " অটোর সামনে তো? সাবধানে আয়..."  
চারদিকে তাকিয়ে  বেনামীর তেমন করে কিছু চোখে পড়ে না, চড়া রোদ  আর চারপাশের অতিরিক্ত হয়ে যাওয়া রঙ গুলো ওর খুব একটা ভালো লাগে না...
গরমের ছুটি শান্ত দুপুরের পাখার আওয়াজ,  আর মায়ের আঁচল থেকে ওই যে রান্নাঘরের গন্ধ - বেনামীর হঠাৎ যেন মনে পড়ে যায়...

সপ্তাহের এই একটা দিনই ওদের কাজ-কলেজ তাড়াতাড়ি থামে... তারপরই একজন মেট্রো...আর একজন বাস... 
... বেনামী ব্যাগের ভেতর, তখন ল্যাবে ফেলে-আসা রুমালটা খুঁজছে...
অটোটা এসে থামতে,  তাকিয়ে দেখে সামনের বাঁদিকের সিট থেকে নামছে বদনাম...
বেনামীর ঠোঁটে তখন অজান্তে-হাসি...
"এই রোদের মধ্যে কেউ দাঁড়ায়! ওই দিকেই তো ছায়া ছিল!" - আর্ট পেপারের রোল গুলো সামলাতে সামলাতে বকুনি দেয় বদনাম...
রোজ যেখানে দাঁড়ায় সেখানেও যে রোদ,  খেয়াল করেনি ছাতা-অপছন্দ বেনামী...
" আমি দাঁড়াই"- দুষ্টু হাসে বেনামী...

পকেট থেকে ছোট্ট নোটবুক বের করে বেনামীকে দেখায় বদনাম....
"তিনমাস বাকি, আর".... "একগাদা কাজ বাকী তাই তো?" -বদনামের কথাটা বলে ফেলে বেনামী...
"প্রথম যে গ্যালারিটা তোকে দেখিয়েছি, ওখানে"-বেনামীর দিকে তাকিয়ে থাকে বদনাম...
"দরজা দিয়ে ঢুকে এগিয়ে  সামনের দেওয়ালে"-বেনামী চোখ সরায় না...

হাঁটতে হাঁটতে ওরা ততক্ষণে গঙ্গার ধার....
জলের ওপর শেষ-দুপুরের গ্রীষ্ম ফুরিয়ে আসছে....

ওরা কথা বলছে না...
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে ছুঁয়ে যাচ্ছে আঙুলে আঙুল...
ওরা পেরিয়ে যাচ্ছে ভোট চেয়ে চেয়ে বিশ্রী দেওয়াল লিখন- গাছতলার মন্দিরে চালানো উৎকট গান- হাত পাতা ভিখারী আর হাত পাততে শেখা তার  বছর আটেকের ছেলেটা...
ঘাটের সিঁড়ি  দিয়ে নেমে ওরা দাঁড়িয়ে থাকে খানিক...
মৃদু হয়ে আসা সূর্যের আলোয় বিকেল শুরু হবে...

"শোন"- আর কিছু বলতে পারেনা বদনাম...
বেনামীর রোদে-পোড়া কপাল...  কপালের টিপ....তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর স্বপ্নগুলো মনে পড়তে থাকে....
বেনামী ওই দৃষ্টিটার দিকে তাকিয়ে থাকে....
ওদের চারপাশে তখন আরেকটা আগুন-বিকেল...

বেনামী ভাবতে থাকে... এটা ভালোবাসা না "ভালোবাসি"...




No comments:

Post a Comment