Monday, July 2, 2018

সরলরেখা : দু'জন এবং... : ১০


...ব্যস্ততার একটা অদ্ভুত চরিত্র আছে,খুঁটিনাটি দেখার ক্ষমতাকে কেমন একটা অবশ করে দেয়, একটা অদ্ভুত স্বয়ংক্রিয়তা; প্রাতঃকৃত্য, প্রাতরাশ আর যাবতীয় প্রাত্যহিকীর ওপর দিয়ে চোখ-কান বন্ধ করে অনর্গল হেঁটে যাওয়া...

যার যেটা রোজনামচা সেটা নির্বিবাদে করে যাওয়া...


...ব্যস্ততার একটা অদ্ভুত চরিত্র আছে,খুঁটিনাটি দেখার ক্ষমতাকে কেমন একটা অবশ করে দেয়; ব্যস্ততা, একদিকে বেশীক্ষণ  তাকিয়ে থাকতে দেয়না, এককথা  বেশীক্ষণ  ভাবতে দেয়না, এক রাস্তায় বেশীক্ষণ  হাঁটতে দেয়না... ক্রমাগত এই বাস থেকে ওই বাস, এই গলি পেরিয়ে ওই গলি, এই জামা বদলে ওই জামা,  এই চিন্তা থেকে ওই চিন্তা, এঘর  থেকো ওঘর,ওপর -নীচ, ডানদিক-বাঁদিক, চরকিপাক!

ব্যস্ততা,  খানিকক্ষণ থামতে দেয়না, অপেক্ষাও করতে দেয়না!

এগোতে থাকা সময়ে তাড়াহুড়োই নাকি স্বাভাবিক!
ব্যস্ততাই এগিয়ে থাকার লক্ষণ!

সকাল -বিকেল সবাই দৌড়াচ্ছে...
বড়-মেজ-সেজ সবাই দৌড়াচ্ছে...
এপাশ-ওপাশ সবাই হাঁসফাঁস... কারণ দৌড়াচ্ছে...

শহরে দৌড়াচ্ছে- গ্রামে দৌড়াচ্ছে..
দেশে দৌড়াচ্ছে -বিদেশে দৌড়াচ্ছে...

বাইরে দৌড়াচ্ছে...
ভেতরেও দৌড়াচ্ছে...


এর'মই একটা দৌড়াদৌড়ির সময় চলছে ক'দিন  ধরে...

এদিকের ব্যস্ততা ফুরোলো আর ওদিকে ব্যস্ততা শুরু...
এ'জনের ব্যস্ততার শেষ দু'দিন ও'জনের ব্যস্ততার প্রথম দুই....
একজনের হাতে রঙ তো আরেকজনের মুখে বই...
একজন আর্ট গ্যালারি তো আরেকজন রেকর্ডিং স্টুডিও...
একজন তিনদিনের জন্য পাহাড়ে তো আরেকজন এক সপ্তাহের জন্য দেশের বাড়ি...

ব্যস্ততার উল্টোদিকে হাঁটা ওরা দু'জন কেমন যেন একটা ব্যস্ততার গোলকধাঁধাঁয়...

এই ব্যস্ততার ফাঁকফোকর গলে....  ওদের দেখা হয়েছে এলোমেলো...

কলেজফেরতা ওই পনেরো মিনিটে,  যাওয়ার পথে ভিড় মেট্রোয় দু'জনের একজন নেমে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আর এমনই একটু করে কুড়িয়ে-বাঁচিয়ে  দেখা হয়েছে ওদের...

... বদনাম যেদিন আলুকাবলি এনেছিল রঙ-কাগজ কিনে ফেরার সময়ে, বেনামী সেদিন ওকে একটিবার দেওয়ারও সুযোগ পেল না,ততক্ষণে বেনামীর লাইব্রেরি যাওয়ার বাস হাজির... আর সেদিন মেট্রো থেকে নামার সময়  প্রত্যেকবারে মত সবার চোখের আড়ালে বেনামীর হাত ছুঁতে পারলনা বদনাম, হুড়মুড়িয়ে নামতে যাওয়া একজন মহিলার ওড়না বদনামের ব্যাগে আটকে হ্যাঁচকা টান...
শেষ মাসের ইলাস্ট্রেশন গুলো   টেবিলের পেপারওয়েটের নীচে রাখতে রাখতো বেনামী ভাবছিল -বদনাম সেই কবিতাটার লাইনগুলো আবারও বলবে... বদনাম বলেনি, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে জলের বাটি উল্টে থইথই...
বদনামের সেদিন ফিরতে গিয়ে ভীষণ দেরী,  মেট্রো খারাপ, বেনামীকে ফিরতে হলো -সাতটা নাগাদ পড়াতে যাওয়া, বেনামীর 'আজ আসি' -শব্দ দুটো মেসেজ বক্সে নিয়ে কিছুতেই ভাল্লাগছিলনা ওর...
তারপর যেদিন  গাঢ় নীল শাড়ি-বেনামী ভীষণ হাওয়ায় চুল খুলে, বদনাম একবারও বলল না "বেঁধে নে",অটো থেকে নেমে দৌড়ে টিকিটের লাইনে...
সেদিন বেনামীর চোখে জল চোখে পড়েনি, সেদিন বদনামের আঙুল কেটেছে মূর্তি তৈরীর স্প্যাচুলায় - বেনামী দেখেনি, দেখেনি "বর্ষা"-সিরিজের আঁকাগুলো শেষ হয়েছে...দেখেনি ওর জামার বোতাম ছিঁড়েছে, দেখেনি রাস্তা পার হয়ে যাওয়ার সময়ে বদনাম ওর দিকে তাকিয়ে ছিল সারাক্ষণ...

বদনাম শুনতে পারেনি বেনামীর গান, পড়া হয়ে ওঠেনি নতুন কবিতাগুলো,কাগজের অফিসে যাওয়ার তাড়ায় শোনা হয়নি গল্প, দেখা হয়নি বেনামী দুল পরতে ভুলছে, বাকী থেকেছে কথা...

সেই যেদিন ছাদে বসে থাকতে থাকতে বেনামী ওকে ফোন করছিল... ফোন চাপা পড়েছে বইগুলোর তলায়...  কথা  বলা হয়নি...
বেনামীও বোঝেনি বদনাম তখন আঁকছে " তারা-রাত", ক্যানভাস জুড়ে তারা ঝিলমিল রাত-আকাশ আর একপাশে দুটো বাড়ি...
ভেজা চোখ নিয়ে ছাদ থেকে নেমে বসতে হয়েছে পড়ায়....

এর'ম অনেকগুলো খাপছাড়া দিন, ভীষণ ব্যস্ততায় দমবন্ধ দিনের  পর  - ওদের দেখা হয়েছে আজ...

এই ক'দিন ধরে কেমন যেন একটা মনখারাপী ছায়া...  কেমন যেন একটা অপছন্দের স্বাদ....

চাইতে গিয়ে না চাইতে পারা, বলতে গিয়ে না বলতে পারা , দেখতে গিয়ে না দেখতে পারা...

হাত ধরে টানতে টানতে কেউ যেন সরিয়ে নিয়ে গেছে প্রতিবার...
ঢেকে দিয়েছে চোখ...

বুকের মধ্যে  একদানা বালি নিয়ে আজ দেখা হয়েছে ওদের...

কে কাকে কখন খুঁজেছে, কার চোখে কখন
জল-ছলছল, কার মনে কখন মেঘ-গুড়গুড়, কার কখন ঘুম এসেছে, কখন কীভাবে লেখা থেমেছে,  কখন কতটা খারাপ লাগা...
 বুঝতে ভুল হয়েছে... বোঝার সময় পায়নি...

হিসেব ভুল হয়েছে... হিসেব করার সময় হয়নি...

সেই সব এলোমেলো  হিসেব নিয়ে ওদের আজ দেখা হয়েছে...

কীসের একটা অনভ্যাস যেন...

 দু'জনেই চুপ...

চারপাশে একটা সদ্য জাগা ভোর...
ঘাটের শেষ ধাপটায় ওরা দু'জনে পাশাপাশি বসে, জলে পা ডুবিয়ে...

বদনাম দেখছে বেনামীর মুখের ডান পাশে নরম চুলগুলো ঝিরিঝিরি উড়ছে...

বেনামীর মুখ জলের দিকে,তবু ও জানে বদনাম ওর দিকে ফিরে...

... বেনামী  পাশ ফিরে তাকায়...

এতদিনের গায়ে লেগে থাকা ধুলোবালি খসতে শুরু করে...

বদনাম বলছে-
 " এখন তোমার আকাশ ভরা গান
এখন তোমার দু'পাশে ধানখেত
এখন তুমি টলমল নৌকায়

এখন তুমি ভীষণ আমার মতো
এখন তুমি ঝলমল জ্যোৎস্নায়"

- বেনামী শুনছে... শুধু শুনছে...
বেনামীর নিজের লেখা কবিতার লাইন....ব্যস্ত সময়ে বদনামের মেসেজবক্সে  পৌঁছেছিল কোনো একবারের রাতজাগায়....

বদনাম থামে...
বেনামীর মুখে এসে পড়েছে সকালের রোদ্দুর...

বেনামী ব্যাগ থেকে বের করে  বদমামের হাতের ওপর রাখে, একগুচ্ছ ফোটোগ্রাফ - প্যানোরমিক ভিউতে পুরো গ্যালারিটা, কাচের ওপাশে বৃষ্টি আর এপাশে "বর্ষা"-সিরিজের পঁচিশ নম্বর ছবি - "আসন্ন"-একটা কোলাপসিবল বারান্দা- একটা জুঁই গাছ-আর মেঘলা আকাশ,একটা তিনফুট বাই পাঁচফুটের ক্যানভাস -কালো পুকুরের জলে  বৃষ্টি পড়ছে- সামনে দাঁড়ানো বদনাম-ফোকাস লাইট এসে পড়েছে চশমায়...
বেনামীকে সেদিন  চলে যেতে হয়েছিল তাড়াতাড়ি.... তবু...

মুহুর্তগুলো  হাতে নিয়ে ...  কিছু বলতো পারেনা বদনাম...  বেনামীর হাত নেয় হাতের মুঠোয়....

-"বোতাম ছেঁড়া জামাটা আবার পড়েছিস!" - ছন্দে ফেরে বেনামী...
... চোখে চোখ রেখে বেনামীর বেঁধে রাখা চুল খুলে দেয় বদনাম...

.... সকালের রোদ্দুর আরও উজ্জ্বল  হচ্ছে চারপাশে...

ওরা বসে আছে পাশাপাশি...

পাশের রাস্তা  দিয়ে চলে যাচ্ছে গাড়ি-মানুষ-ব্যস্ততা...

ওরা বসে আছে পাশাপাশি...

ওরা ভাবছে...  সময়ের থেকে ওরা একে অপরকে চেয়েছে... না  সময়ের কাছে একে অপরকে পেয়েছে...?

Saturday, June 23, 2018

সরলরেখা : দু'জন এবং... : ৯

  প্রতিটা বাড়িতে, প্রতিটা মানুষের  একটা নিজস্ব ঘর থাকে; চারদেওয়ালে আটকানো নয়,তবে চারদেওয়ালের চেয়েও বেশী নিভৃত... একটা নিজের জায়গা...

একটা ছোট বারান্দা  বা একটা ভাঙা আলমারি,  একটা চৌকির তলা বা একটা কাঠের বাক্স, একটা সিঁড়ির কোণ,  হয়তো বা পেয়ারা গাছের তলায় বাগানের একটুকরো, কিংবা ওই একখানা বক্স জানলা.... একটা  নিজের জায়গা...

যেখানে সবথেকে ভালো ঘুম আসে, যেখানটায় এসে পড়ে সবথেকে মিঠে রোদ্দুর,  যেখানে সবচেয়ে কাছ থেকে পাওয়া যায় মায়ের আঁচলের গন্ধ আর সবচেয়ে স্পষ্ট শোনা যায় দিদার সেলাইমেশিনের শব্দ, যে জায়গাটা থেকে দেখা যায় শব্দছকের সমাধান করতে করতে একটু-একটু হাসছে দাদু  আর দাড়ি কামাতে কামাতে বাবা গাইছে কিশোরকুমারের গান...

একটা নিজের জায়গা...

 যেখানে  খানিকক্ষণ এক্কেবারে  চুপ করে বসা যায়... লিখে রাখা যায় যা যা মনে আসছে... গাওয়া যায় সুর-নড়বড়ে সবেমাত্র তোলা গানটা...লুকিয়ে রাখা যায় গোলাপী চিরকুট, আঁকার খাতা...ছোটবেলার ঘুঙুর... মোমরঙের টুকরো রাখা যায় যত্ন করে...
যেখানে বসে কাঁদলে দেখতে পায়না কেউ...যার পাশেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জানলাটা...
সেখানে... একটা নিজের জায়গা...

এ'রকম একটা জায়গা আছে বদনামের... সারা ঘরে রঙের গন্ধ,কবিতার বই, ইজেল, খালি -আধখালি ক্যানভাস, একটা একফালি খাট, খাটের পাশে পরপর রাখা সদ্য-পুরোনো-বেশ পুরোনো  ছবিগুলো...
আরও অনেককিছুই আছে, সেসব সবাই দেখতে পাবেনা...

আজ, বদনামের এই ঘরটায় শেষদুপুর... সবে বর্ষা ঢুকেছে... প্রথম বৃষ্টির পর থেকে আজ তৃতীয় দিন...

বেনামীর জামার সবুজ - আধভেজা, দরজার পাল্লায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল খুলছে বেনামী...
বদনাম তখন আধশোয়া হয়ে, জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে...বালিশের তলায় ভাঁজ করে রাখা কী যেন একটা কাগজ...
চুপ...
মেঘ ডাকছে ভীষণ..
বেনামী  রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান ধরল -অন্তরা থেকে...
ইশারায় একবার জিজ্ঞেস  করল... কী হয়েছে...

উত্তর নেই...

বদনাম...  ওর পাশে রাখা ক্যানভাসটা নিয়ে এলোমেলো রঙ চাপাতে থাকে...
গান থামায় বেনামী...

বদনামের বাঁ পাশের কাঠের টুলে বসে বেনামী চুপ করে দেখে... ধূসর ঘেঁষে ক্যানভাসে পড়ছে নীল...
নীলের ধারে ম্যাজেন্টা -বোগেনভিলিয়া...
তারপর বৃষ্টি-ভেজা আলো-আলো -হলুদ ছড়াতে ছড়াতে মিশছে কালোয়...
বেনামীর ভালোলাগে...

 যে ক'টা মনখারাপী -কথা ছিল...সেগুলো আজ থাক...

এবার চুপ করে থাকতে ভালোলাগে বেনামীর...

"কী রে!  আমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই তোর"- অস্থিরতা বাড়ে বদনামের তুলিতে...

আলতো হাসে বেনামী...
তারপর হেঁটে যায় কাছে...
বদনামের পাশে রেখে দেয় কীসের  যেন সব কাগজ...
-" ছ'মাসের প্রতিটা এন্ট্রি,  তারিখ অনুযায়ী পরপর আছে রে"- ভীষণ চেনা স্বর, তবু আবার অবাক করে বেনামী...

বদনাম  বালিশের তলা থেকে বার করে  কাগজের অফিসের চিঠি আর একটা টাকার খাম...
"কেমন  যেন একটা লাগছে কাল থেকে" -বদনামের অস্থিরতা একটু ধীর হয়...

" অ্যাকাউন্টে রাখিস.. তারপর আরও কেমন যেন একটা লাগবে!"- বেনামী হালকা করতে চায়  ভার...

"একটা ইলাস্ট্রেশনও না... একটাও দেখতে চায়নি মা " - বদনামের গলা কেঁপে যায়...

বেনামী দু'হাতের ভেতর টেনে নেয়  ওর হাত...
বদনাম ভেঙে পড়ে...

বেনামী ওকে জড়িয়ে নেয় ওতপ্রোত...
বৃষ্টিভেজা,  শান্ত  বেনামী  ছুঁয়ে থাকে ওর সমস্ত ব্যথা...
কান্নায় কাঁপতে থাকা বদনাম...  আস্তে আস্তে স্থির হয়...
হালকা লাগে...
বেনামীর বুকে টেনে- নেওয়া এই শান্তির ভেতর একটা সুন্দর ঘুম আসে...

সেই শান্তির ভেতর মনে পড়ে অনেক কথা...
... সেই সমস্ত কথা যা এই ঘরের ভেতর আড়াল করে রেখেছে বদনাম- সেই সমস্ত মনখারাপ- আজকের  মতোই বা আজকের থেকেও বেশী...
 সেই সমস্ত না পাওয়া... ফিরিয়ে দেওয়া -ফেলে দেওয়া সব...অভিমান... রাগ...  লজ্জা...

খাটের পাশের টেবিলের ড্রয়ারে... খাটের পাশে রাখা ওই পোড়া ক্যানভাসে... দিদুনের তৈরী করা পাশবালিশটায়... জীবনানন্দ  কাব্যসমগ্রের ভেতর...ছোটবেলার আঁকার  খাতায়... কবিতা লেখার ডায়রিতে... ছোট আলমারিতে রাখা পেতলের ওই বাক্সটায় -যাতে রাখা আছে স্কুলের ব্যাজ, ফিজিক্স স্যারের হাতের লেখায় -"চরৈবেতি", মামাবাড়ি থেকে লুকিয়ে আনা নিজের ঝিনুক-বাটি আর আরও অনেককিছু...
এই সবের ভেতর গোপনে রাখা সেই সব কথা.. সেই সমস্ত সত্যি...
যা এই ঘরে বসেই বেনামীকে বলেছে বদনাম... বেনামীর কাছে...  বেনামীর সঙ্গে, কেঁদেছে -হেসেছে...

এই সব কথার ভেতরে বেনামীর মুখটা মনে পড়ে...
মনে পড়ে কীভাবে চুপটি  করে থাকা মেয়েটা এই ঘরে বসে ভীষণ হেসেছে,  কথা বলেছে অনর্গল,  কেঁদেছে অঝোরে...  বেঁধেছে গান -একের পর এক...

কীভাবে বুঝেছে..? কীভাবে সামলেছে ওরা দু'জন...?

ওদের ঘিরে থাকা ঘরটা... আরেকটু ঘন হয়ে আসে ওদের চারপাশে....


...চোখের জল শুকিয়েছে ততক্ষণে...
মাথা তুলে বেনামীর দিকে তাকাতে হেসে ফেলে দু'জনেই...

"আজ থাক,  অন্যদিন "- মনকে আরেকবার শাসন করে বেনামী...

চুপ...

বেনামীকে এবার কাছে বেঁধে নেয় বদনাম...
ছুঁয়ে দেয় ঠোঁট...

নি:শব্দ দৃষ্টি বিনিময়... স্পর্শ...

" জোর করে ভিজে ভিজে এলি কেন?" -বদনামের হাতে ,  বেনামীর যত্ন করে গোটানো, গাঢ় নীল ছাতাটা...

প্রতিটা বাড়িতে, প্রতিটা মানুষের  একটা নিজস্ব ঘর থাকে...
যেখানে নিজের সমস্তটা নিয়ে... নিজের সমস্ত সত্যিটা নিয়ে বাস করা যায়...
যেখানে বলতে হয়না, বলে বোঝাতে হয় না...

তেমনি, প্রতিটা মানুষের একজন নিজস্ব মানুষ থাকে...
একটা নিজস্ব্ জায়গা...

বৃষ্টি পড়ছে... আবছায়া চারপাশে নিবিড় হয়ে আসছে অনুভূতি...

ওরা উত্তর পায়না... ওরা একের অপরকে আকাশ দিল না আড়াল...?

Sunday, June 10, 2018

সরলরেখা : দু'জন এবং... :৮

নিদ্রামগ্ন হওয়ার মতোই মারাত্মক ভাবে যে জলমগ্ন  হওয়া যায় তা এই শহর খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়ায় খামতি রাখেনা...
এক-কোমর জল, হাঁটু ছোঁয়া জল, পায়ের পাতা ভেজানো জল, জল-জল...  সমস্ত  রকমফেরই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাজানো আছে ; কোনোটা এই গলিতে তো কোনোটা ওই রাস্তায়,  কোনো কোনোটা আবার আন্ডারপাসে, কোনোটা বড়রাস্তায়...

সেই জলে ভাসাভাসি করে ভালো -খারাপ সবই...
তবে, সহজে ভেসে যায়না কিছু,এই লাইফ-ইনশিওরেন্স-বিশ্বাসী শহরে জমে থাকেই বেশী...
অটো ঘুরপথে ঘুরে ঘুরে পৌঁছায়,রিক্সার ভাড়া বাড়ে দুদ্দাড়িয়ে, দু'চাকা -চার চাকা বুক জলে দাঁড়িয়ে দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলে...কিছু জামা বারান্দার তারে অসতর্ক-ভেজে বারবার আর বাকিরা আধভেজা হয়ে  মুখগোমড়া করে থাকে ঘরের ভেতর...

পরিপাটি শহর... জলে ভিজে, স্যাঁতস্যাতে শার্ট পরে,  মোবাইল -ল্যাপটপ সামলাতে সামলাতে অফিসে ছোটে, জলে মিশে ট্র্যাফিক লাইট, শপিং মল, বাস-ট্যাক্সি-ট্রাম সব একরঙা হয়ে গিয়ে কেমন যেন অগোছালো হয়ে যায়...
জলের ভেতর দিয়ে সাবধানী চলাচলের গায়ে ছিটকে আসে চাকার নীচ থেকে পিছলে আসা জল!

খবরের কাগজের শিরোনাম বলে ' টানা তিনদিন চলবে ভারী বর্ষণ, শহরবাসীদের দুর্ভোগ'...

 দেখে হাসি পায় বেনামীর - "বর্ষাকাল, ভয় পায় নাকি কেউ!"
"ঠিক বলেছিস!! ছাতা-টাতা সব জলাঞ্জলি দিয়ে বৃষ্টি মাথায় বুক চিতিয়ে বেরিয়ে পড়া উচিত"- চোরা ঠাট্টা মিশিয়ে বিপক্ষের গোলকিপিং করতে থাকে বদনাম...

টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরুর থেকেই তর্ক চলছে...
"এই এক্ষুণি জোরে শুরু হয়ে যাবে রে" -দ্রুত পা চালায় বদনাম...
"আমরা তো সব নুনের পুতুল... না রে!"- যুক্তি দিতে দিতে তাল মেলাতে হুড়োহুড়ি করে বেনামী...
"কারও কাছে ছাতা নেই কিন্তু "- বেনামীর হাত ধরে একটানে সরিয়ে আনে বদনাম...
সঙ্গে সঙ্গে ঝেঁপে বৃষ্টি...

ঝুলবারান্দার নীচের ছাউনিতে দাঁড়িয়ে, বেনামী তখন একেবারে চুপ...
মুখে  এসে লাগছে বৃষ্টির ছাঁট...

বদনাম দেখে... ঝরতে থাকা আকাশটার দিকে তাকিয়ে আছে বেনামী, ওর চশমার কাচে জলের বিন্দু...
তারপর বাঁ হাতে চশমা খুলে মুখটা এগিয়ে দিয়েছে বৃষ্টিতে...
বেনামী হাসছে...  তবু মাঝে মাঝে যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর ঠোঁট দুটো...

বদনাম... অপলক...

আলতো উঠে আসে বেনামীর ডান হাত...খুঁজতে থাকে কী যেন....
ওর হাতটা ছুঁয়ে দেয় বদনাম...
বেনামী আঁকড়ে ধরে...

বৃষ্টি বাড়তে থাকে...

পিঠ বাঁচানো লোকেরা সব মাথা, চটি বাঁচিয়ে দুদ্দাড় দৌড়ে এতক্ষণে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে হয়তো...
রাস্তা খালি...
রোয়াকের লাল মেঝে শুধু বেবাক ভিজছে...

ঘরের ভেতরে চুপচাপ বসে বৃষ্টি দেখা বদনামের বেশী প্রিয়...
বৃষ্টি আর কবিতা...  আর ছোটবেলার মতো... আঁকার খাতায় জলরঙ...

বেনামী চায় বৃষ্টি ভিজতে...

তর্ক হয় দু'জনের...

বদনাম অবাক হয়ে দেখে... শান্ত মেয়েটা বৃষ্টি পড়লে কেমন  এলোমেলো হয়ে যায়... কী অদ্ভুত চঞ্চল!

আর বদনাম নিজে!
ক্রমাগত শান্ত, আরও শান্ত.... ভেতরের ভবঘুরে মানুষটাকে এভাবে ঘরকুনো হতে দেখে , ও নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারেনা....

বদনাম.... শুধু দেখতে থাকে বেনামীকে...
ওর হাতটা মুঠোর মধ্যে নিয়ে আড়াল থেকে যতটুকু বৃষ্টি পাওয়া যায় ততটুকুতেই ভিজছে বেনামী...
ওর থেকে আরও একটু ভেতর দিকে দাঁড়িয়ে বদনাম... বৃষ্টি পাচ্ছে না...
আর্দ্র-শীতল চারপাশ...স্বভাব-টানেই ও ভেতরদিকে গুটিয়ে যাচ্ছে...  একটু একটু করে...
কিন্তু ওর হাত ছুঁয়ে থাকা বেনামীর হাতের ওই উষ্ণতা আজ ওকে কী যেন একটা বলছে....বেনামীর গলায় শোনা লালন ফকিরের ওই গানটা বারবার কানে বাজছে...
কেমন যেন একটা আলগা হওয়ার ডাক... একটা ভেসে যাওয়ার অনুভূতি...

বেনামী তখনও লক্ষ্য করেনি...এই অঝোর বৃষ্টি সামনে নিয়ে ও এতটা চুপ করে আছে কী করে! কী করে এখনও আড়ালের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে ও!কেমন যেন একটা ভেতরদিকের টান,  একটা থিতিয়ে পড়ার মতো অনুভব... বদনামের গোধূলি-মাখা ঘরটা মনে পড়ে ওর...
বারবার...


ভীষণ জোরে একটা বাজ পড়ে...
হালকা গোলাপী আলোয় চোখাচোখি হয়ে যায় দু'জনের...

বদনামের হাতটা মুঠোয় ধরে, আরও একটু কাছে টেনে, বারান্দার আরও একটু ভেতরে দিকে সরে যায় বেনামী...
বৃষ্টি-শহরের নিবিড় আলো চোখে মেখে ওরা খানিকক্ষণ চুপ....

বদনামের হাতের পাতা আঙুলে আঁকড়ে নিয়ে... নিজের বুকের ওপর রাখে বেনামী....

..... স্মৃতি ওলটপালট করে তখন শান্ত হয়ে যাচ্ছে অনেক অস্থিরতা... মৃদু হয়ে যাচ্ছে অনেক চিৎকার...  অনেক কথা....


বদনাম... বেনামীকে একবার  নাম ধরে ডাকে...
তারপর বেনামীর হাত ধরে দৌড়ে  নামে রাস্তায়....
অক্লান্ত, অঝোর বৃষ্টির নীচে ভিজে যায় দু'জনেই.... আপাদমস্তক...

বৃষ্টি আরও বাড়ে...
ভীষণ বৃষ্টির নীচে দাঁড়িয়ে  ওরা  হাসছে ...  দু'জনে...

বেনামী ভাবে - বদনাম ওর ঘর না ভাঙচুর...?

Sunday, June 3, 2018

সরলরেখাঃ দু'জন এবং... :৭

... সমুদ্রের তীর...
যেখানে একটু একটু করে মাটি শেষ হয়ে মিশে যাচ্ছে জলে...
ফুরিয়ে যাচ্ছে দেশ,দেশভাগ...

যেখানে বসে সামনে তাকালে শুধু অথৈ জল... অথৈ গভীরতা...
অপার সমুদ্র যেখান থেকে এগিয়ে যেতে যেতে  মিশে যায় দিগন্তে...

যে সমুদ্রতীর বুক পেতে নিতে  থাকে সব ঢেউ...

একটু একটু করে ভেঙে যায় রোজ... একটু একটু  করে গড়ে ওঠে রোজ....

 সাক্ষী  থাকে...
অসংখ্য সমুদ্রযাত্রা... অসংখ্য নৌকাডুবির...

আর... প্রতিটা সৌরদিনের...


সের'মই একটা সমুদ্রতীরে বসে আছে বদনাম...
সূর্য  ডুবছে দূরে...
ভীড় নেই.. গাঢ় লাল সূর্য-ঘেরা সোনালী তেজ মৃদু হয়ে মিশে যাচ্ছে নোনাজলে...
ভেজা বালির ওপর পা রেখে বসে আছে বদনাম...চুপচাপ...
ফোনে নেটওয়ার্ক নেই...  বেনামীর সঙ্গে কথা হয়নি সকাল থেকে...

একটু দূরে একদল লোকজন...  কাচের বোতলের শব্দ আর অস্পষ্ট হইহই মাঝেমাঝে বাড়ছে...

মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ফিরতি পথের পাখি, একটা -দুটো...

... এইখানে এই আর্ট এক্সিবিশনে সুযোগ পেয়ে ওর আনন্দ হওয়ার আগে কান্না পেয়েছিল...
আর বেনামী...  একদম ওর স্বভাববিরুদ্ধ হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল- "এই তো সবে শুরু! "

- বালির ওপর ছোটদের মতো আঁকিবুকি কাটতে কাটতে এসব কথা এলোমেলো মনে পড়ছিল...

বেনামীর সাথে ওর এই এক বিচ্ছিরি মিল...
নির্জনতা ভালোলাগা... নির্জনতা খুঁজে নিতে পারা...
আর এইরকম চুপচাপ বসে হাসা-কাঁদা-ভাবা...

... গ্যালারীর উজ্জ্বল আলোয় ওর কাজগুলো একটা একটা করে মনে পড়ে বদনামের...
বুকপকেট থেকে ওর ছোট্ট নোটবুকটা বের করে...  এলোমেলো স্কেচের ভেতর এখানেই  ও লিখে রাখে প্রতিটা ছবির গল্প - ভূমিকা..

সন্ধ্যে নামছে... আবছা আলোয় যেন আরও বেশী  জীবন্ত হয়ে  যায় গল্পগুলো...
এখানে ওরা পাঁচটা ছবি পছন্দ করেছে...  যেগুলো এখন গ্যালারির সামনে বাঁদিকে সাজানো পরপর...
এগুলোরও গল্প আছে...

বদনাম খুঁজে নেয়... তারপর স্মৃতির সঙ্গে আরেকবার মিলিয়ে নেয়...

প্রথম ছবিটায় কোনো দাগ নেই... আলোছায়া আর জলরঙ... হালকা আর গাঢ় মিশে মিশে রেখা তৈরী হয়েছে...
বদনাম ছবিটার নাম দিয়েছিল 'ঢেউ',  বেনামীর গলায় প্রথম পূজা পর্যায়ের সেই গানটা শোনার পর আঁকা ওই ছবিটা... বেনামীকে প্রথম কাঁদতে দেখেছিল সেদিন...

দ্বিতীয় ছবিটা তেলরঙে...পানা পুকুর ভরা শালুক ফুলের ছবি,  কী জানি কেন ছবিটার নাম দিয়েছিল  'ব্লসম'.... সেই যেদিন বিকেলের পড়ন্ত আলোয় বদনাম, বেনামীর বৃষ্টিভেজা পা ছুঁয়েছিল,  সেদিন সন্ধ্যেয় ফিরেই ক্যানভাসটায় রং দিয়েছিল ও...

পরের দুটো ছবিই কলকাতা শহরের... মিক্সড মিডিয়া... ঠিক শহরটার মতোই...
বদনাম ...  এই সিরিজটার নাম দিয়েছিল 'বাড়ি'... বেনামী
প্রতিটা ছবির জন্য গান লিখেছিল... আর সেই গান শুনতে শুনতে ছবিগুলো শেষ হয়েছিল রাত জেগে...

পাঁচ নম্বর ছবিটা ওয়াশে করা... বদনাম নাম দিয়েছিল 'আলো', একটা মেয়ের পিঠে ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুলের ছবি...
বদনাম যেদিন প্রথম বেনামীর বুকে মাথা রেখেছিল ছবিটা তার পরদিন ভোরে শুরু করা...

....বদনাম বুঝতেই পারেনি কখন ওর চোখে জল এসেছে...

পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আরও কত গল্প...

সিলেকশনের জন্য যখন ছবি পাঠাতে হবে  তখন বেনামীর সঙ্গে ওর ভীষণ ঝড়-বিদ্যুৎ...তারিখ-তাগাদা সেই সময়ের মতো অধৈর্য ওকে করেনি কোনোদিন... তার ওপর জীবনের সবথেকে বড়ো 'এপ্রিল ফুল' হবার মাসটা, সেই মাসের সঙ্গে মিলে গিয়ে কেমন একটা ভয় পাইয়ে দিচ্ছিল ওকে...
ভীষণ জেদ করে,  খুঁজে খুঁজে পেন অ্যান্ড ইঙ্কের কাজগুলো বার করেছিল,  বেছেছিল 'ড্রাউনড্',  ' অদর্শন' আর 'অভিমান'...মন ভালো ছিল না... বলা  ভালো মন খারাপ ছিল...

জমা দেওয়ার দিনের আগের রাতে... ফোনের ওপাশে বেনামীর গলা...
- " একটাও রঙের কাজ দিবি না ঠিক করেছিস তো ?... "


'অভিমান'-টা সরিয়ে রেখে বদনাম পাঠিয়েছিল জলরঙের কাজ 'বৃষ্টি'....

....নোটবুকটা বন্ধ করে বদনাম আবার বুকপকেটে রাখে...
বেনামীকে দেখতে ইচ্ছে করে খুব...

ঠিক ওই সময়ে দু'বার কেঁপে ওঠে হাতের মুঠোর ফোনটা...
...মেসেজ বক্সে বেনামীর হাসি- "আজ পূর্ণিমা রে..."

.... সমুদ্রে এসে ভিজিয়ে দেয় পা...

বদনাম  ভাবতে থাক ওর জীবন বেনামীর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে না বেনামীর জীবন ওর সঙ্গে...?

Saturday, May 26, 2018

সরলরেখাঃ দু'জন এবং... : ৬

.... বেলা বাড়ার চোখ রাঙানো রোদ...
তার দিকে একটা ফিচেল হাসি ছুঁড়ে দিয়ে ঝপ করে মাটি-রঙ জলের ভেতর...
লঞ্চের ধার ছুঁয়ে সাঁতরাতে সাঁতরাতে একহাতে ছোঁ মেরে ধরে নেওয়া দড়িতে বাঁধা পুরোনো টায়ার... হুড়মুড়িয়ে এসে পড়া ঢেউ চোখে মুখে মাখতে মাখতে  হু -হু পেরিয়ে যাওয়া অনেকটা জল...
লঞ্চের মাথা থেকে এক নিঃশ্বাসে জলের মধ্যে!
তারপর সবাইকে চমকে দিয়ে আবারও উঠে আসা ...
একটা দুর্দান্ত জিতে যাওয়ার  মুহুর্ত...আর  ওই যুদ্ধ জয়ের হাসি...

"ওদের মরে যাওয়ার ভয় হয়না!"- ওদের দেখতে দেখতে চঞ্চল হচ্ছিল বেনামী...
জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ  আর মাঝদুপুরে জলের থেকে উঠে আসা একটা আর্দ্র উষ্ণতা... ওদের অসময়ের এই দেখা করার সময়টা জুড়ে আরও -আরও এলোমেলো...

বেনামী জলের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে...
ছোট ছোট ঢেউয়ের কপাল ছুঁয়ে রোদ এসে পড়ছে বেনামীর অযত্নে রাখা চুলে...

লঞ্চের রেলিংয়ে পিঠ রেখে.. বেনামীর দিকে তাকিয়ে বদনাম...
বেনামীর গাঢ় বাদামী চোখের ভেতর এক বিন্দু ঘন কালো আছে... সেটাই খুঁজছে হয়তো...
কিছু মনে পড়ছে?

"কী দেখছিস রে? " - দুষ্টু হাসি বেনামীর চোখের কোনায়....
"তোমায়" -বেনামীকে চমকে দিয়ে গাঢ় হয় বদনামের গলার স্বর....
"এ-ই...."- বেনামী বুঝে নিতে চায়...
খানিকক্ষণের নির্বাক দৃষ্টিবিনিময়....
বদনামের চোখের ভেতরে একটা জমাট কান্না আছে...

বেনামী দেখতে পাচ্ছে সেটা নরম হচ্ছে ক্রমশ...

এই মধ্যদিনের চড়া রোদের নীচে,  চোখের জল...
 বেমানান ?

-"ওভাবে কথাটা বলিনি,  তোমায়".... বেনামীর স্বরে অনেকদিনের না আসা বৃষ্টি...

"জানি" - আর বেশী বলতে পারেনা বদনাম...

সত্যি, বেনামী  জানে... ওই সাধারণ শব্দগুলো কেন বদনামকে এতটা আঘাত দিতে পারলো!

সত্যিই ও জানে...  'মরে যাওয়া' কথাটুকু বদনাম কীভাবে সহ্য করে...  আজও...

জানে, বদনামের চোখের সামনে  কীভাবে চলে আসে  সেই ভীষণ শীতের রাত, সেই পোড়া গন্ধ, সেই আগুনের শিখা, সেই অফিস নোটবুকে লেখা সুইসাইড নোট....
জানে,  বদনামের সেই দুঃস্বপ্নগুলো... সেই সমস্ত রাতজাগা কান্না...  রাগ...

জানে, বদনামের হাতে আঁকা ওর দাদার পোর্ট্রেট,  সেই শীতের রাতে কীভাবে ঝলসে গিয়েছিল আগুনে...
জানে, সেই ক্যানভাস... এখনও   রাখা বদনামের বিছানার পাশে...
জানে, মরে যাওয়ার ভয় কেন এত মারাত্মকভাবে বদনামের বুকের ভেতর...
কেন এই অস্থিরতা... কান্না...

"তোকে যেদিন প্রথম দেখলাম...সেদিন আবার তুলি ধরতে পারলাম...  কিছু আঁকতে পারিনি... সারারাত..   শুধু রঙ দিয়ে গেছিলাম ক্যানভাসে..."

বেনামীর ভীষণ ইচ্ছা করল বদনামের হাতটা চেপে ধরে নিজের দু'হাতের ভেতর...আগলে নেয় এই অস্থিরতা...
পারল না... এই ভীড়ের মধ্যে... শুধু তাকিয়ে রইল ওই কান্নার ভেতরে...

.... জলের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ল আরেকটি কিশোর... ছিটকে আসা জল ভিজিয়ে দিলো ওদের দু'জনকেই...

আধভেজা ব্যাগের থেকে ও বার করল একটা ভাঁজ করে রাখা কাগজ...

বদনামের বুক পকেটে রাখতে রাখতে ও বলল- "তিনি লিখেছেন... স্কেচ না  শুধু রঙের কথা..."

 বদনামের মুখে তখন....সেই হাসিটা...

বেনামী  সেই হাসিটা দেখতে দেখতে ভাবতে থাকে - স্বপ্ন প্রেমের মতো না প্রেম স্বপ্নের মতো...

ওদের অজান্তে...  কখন যেন আঙুলে আঙুল ঠেকে গেছে....

Saturday, May 19, 2018

সরলরেখাঃ দু'জন এবং... : ৫


শহরের নাকি মন নেই, গান নেই,  ক্যানভাস নেই...
ট্র্যাফিক আর কংক্রিটে আটক নাকি সব...
l
শহরে নাকি রাগ করলে রোদ হয় না, মনখারাপ হলে মেঘ হয়না, হয়না লুকিয়ে -দেখা কনে দেখা বিকেল- ঘুড়ি ওড়ানো আকাশ... প্রেমে পড়লে কৃষ্ণচূড়ার লাল হয়না....অভিমানের শান্ত দিঘি হয়না... ভেঙে পড়লে বৃষ্টি হয়না...
এমনকী... বিপ্লবী হলে রক্তপাতও হয়না...

শহরের নাকি মন নেই...

শহর ভিখারীকে খাবার দেয়না, উলঙ্গ শিশুকে জামা দেয়না....প্রেমিক-প্রেমিকাকে আগল দেয় না.... বাড়িকে প্রতিবেশী দেয়না... মানুষকে আত্মীয় দেয়না....

শহরের নাকি মন নেই...
গান নেই... কবিতা..  ক্যানভাস নেই....


ওরা দুজন তখন একটা বন্ধ দোকানের ছাউনির তলায় পাশাপাশি...

রাস্তার মোড়ে যে জমায়েতটা হয়েছে তার থেকে বেশ খানিকটা আড়ালে...
ওখানের কোনো লোকই ভাবেনি এর'ম জরুরী সমাবেশ ওলটপালট করে দিয়ে এইরকম একটা ঝড় উঠবে!

মেঘ ডাকা,তুমুল বৃষ্টি... এলোপাথাড়ি উড়তে থাকা -দড়িতে লাগানো সার সার কাগজের দলীয় পতাকা,
নামীদামী গয়নার দোকান আর সুগন্ধীর হোর্ডিং কাঁপিয়ে হাহা করতে থাকা হাওয়া আর  ধোঁয়াধুলোর শহুরে-আকাশ চিরে বিদ্যুৎ...

এসবের মধ্যে ওরা সামলে নিতে চাইছে ওদের নিজেদের ঝড়....

গত তিনদিন ধরে শুধু এলোমেলো কথা, জমাট চুপ করে থাকা, গুমোট বিকেল ওদের মতোই বলতে পারেনি অনেককিছু...

ভীষণ চঞ্চলতা নিয়ে তাই ওরা দেখা করেছিল এই ক্লান্ত সন্ধ্যেয়....

ঝড় ওঠার আগের মুহুর্ত অবধি তর্ক চলেছে, কেউ শুনতে চায়নি কথা, ভাঙতে চেয়েছে যুক্তি...

তারপর এই ওলোটপালট করা ঝড়...
তখন থেকে কথা হয়নি কোনো...
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মনে পড়েছে কথা... অনেক কথা...
মনে পড়েছে দু'জনেই কী অদ্ভুত ভাবে আক্রমণ করেছে একে অপরকে... সেইসব শব্দ... কানে বাজতে থাকা ওই কন্ঠস্বর...
কীভাবে ওরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে একে অন্যের দূর্বলতা -হেরে যাওয়া গুলো....
মনে পড়েছে কীভাবে বোবা হয়ে গেছে দু'জনেই...
মনে পড়েছে ফোনের ওপারে শোনা কান্না,মনে পড়েছে ওরা কীভাবে নিজেদের বিপরীতে গিয়ে আঘাত করেছে একে অপরকে...

আর...  এর সাথে মনে পড়েছে  আরও গোপন...  আড়ালের ব্যথাগুলো... যেগুলো ওরা আগলে রেখেছে আপ্রাণ...
নিজের ব্যথাগুলো ছাপিয়ে আরেকজনের যন্ত্রণাগুলো...


ওদের ঘিরে উন্মত্ত ঝড়...
নিজেদের কথাকাটাকাটি... নীরবতা... কান্না...  দমবন্ধ হয়ে আসা ওই মুহূর্তগুলো... আরও ঝোড়ো হয়েছে ক্রমশ...
মনের মধ্যে হারিয়ে ফেলার একটা ভয় ঘন হয়েছে আরও.... আর সেই ভয়ের ভেতরে বদনাম আর বেনামী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থেকেছে অনেক্ষণ...

বজ্রপাত আর সমাবেশের কর্কশ চিৎকার...
তারই মধ্যে দামাল হাওয়া... তীরের মতো মুখে এসে লাগা বৃষ্টির ছাট... পিচের রাস্তায় অবিশ্রান্ত জল আর সেই জলে পিচ্ছিল হয়ে ওঠা.. গাড়ির লাল-হলুদ আলো...
বিদ্যুতের গাঢ় গোলাপি আভা আর ছুটে যাওয়া আ্যম্বুল্যান্সের আওয়াজ...

ওদের ভেতরের ঝড়... অস্থিরতা.. বেড়েছে ওই ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে...

ওরা... পাশাপাশি দাঁড়িয়ে...

তারপর... সেই যখন ভীষণ জোরে বাজ পড়ল খুব কাছেই...
বদনাম...  বেনামীর হাত শক্ত করে ধরে, তাকিয়ে ছিল চোখে...
বেনামীর চোখে তখন তিরতির করে কাঁপছে জল.. সেই জলে কাঁপছে বৃষ্টি আর বৃষ্টিতে মেশা শহরের আলো...
 কেমন যেন অপরাধী হয়ে যাওয়া দু'হাতে ওকে আরও নিবিড় করে নিয়ে সেই চোখের আরও ভেতরে তাকিয়ে কী যেন খুঁজছিল বদনাম...
অস্ফুটে একবার বলেছিল- ভাল্লাগছেনা...
বেনামী..  আরও কাছে  গিয়ে ঠোঁট রেখেছিল বদনামের ঠোঁটে...
বন্ধ চোখ থেকে তখন নেমে আসছে জল...
ঝড় থামছে...

বদনাম আর বেনামী,  এবার পা ভিজিয়েছে জলে... ওদের বাড়িফেরা ভিজছে বৃষ্টিতে...

ওরা... আবারও কী  চিনল?
মানুষের মন না মনের মানুষ...?

Friday, May 11, 2018

সরলরেখাঃ দু'জন এবং... :৪

আকাশ নরম হয়ে আসে... দুপুরের চড়া রোদ হাইরাইজের মাথার ওপর থেকে নেমে আড়ালে যায়...তারপর গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে... খেলার মাঠে... চা-দোকানের বেঞ্চে থিতিয়ে পড়তে পড়তে...
মিশে  যায় স্কুলফেরত আলুকাবলির শালপাতায়-গঙ্গার ঢেউয়ে আলতো কাঁপতে থাকা শেষবেলার আলোয়...

নরম নীল ব্যাকড্রপে... হালকা গোলাপী...
কখনও উজ্জ্বল  সাদা আর দিগন্তছোঁয়া একটা শীতল কমলা সূর্য...
আবার কখনও... গাঢ় কমলা আকাশ আর রক্তলালে গাঢ়তর...
...বিকেল...
সমস্ত দিনটার...  ভীষণ থেকে নরম হওয়ার সময়... আবারও সন্ধ্যের মতো কঠিন আর নির্বাক হওয়ার আগে অনর্গল কথোপকথনের মতো সময়....


এ'রকমই একটা বিকেলের ভেতর ওরা পাশাপাশি শুয়ে আছে...
ছাদটার ওপর ঝুঁকে পড়েছে বিকেল-মাখা আকাশ... বাঁ-পাশে  ফুল-লাল কৃষ্ণচূড়ার অর্ধেকটুকু দেখা যায়...আর
ওদিকে তিনটে সুপুরি গাছ, হালকা হাওয়ায় এদিক ওদিক;  পিছন দিকে দু'-তিনটে বাড়ি খানিক দূরে - বাড়ি না ফ্ল্যাট... ভাগাভাগির ছাদে লোক দেখা যায়না সচরাচর...শুধু আলাদা আলাদা দড়িতে শুকোতে দেওয়া আলাদা আলাদা তলার কাপড়জামা...

এভাবে পাশাপাশি অনেকক্ষণ আকাশ দেখছে ওরা...
এদিকওদিক  দু'-চারটে ঘুড়ি উড়ছে...
বেনামীর ছোটবেলার কথা মনে পড়ে - বিশ্বকর্মা পুজোর সপ্তাহে বাবা ঘুড়ি ওড়াতো খুব...লাটাই হাতে বাবার  দিকে তাকিয়ে ও দেখত ছোট ছেলের  মতো হাসছে বাবা....  কত অন্যরকম হয়ে যেতো বাবা তখন...
বদনাম তখন আঙুল দিয়ে বেনামীর হাতের পাতায় আাঁকিবুকি কাটতে কাটতে অগোছালো ভাবনা গুলোকে সাজানোর চেষ্টায়...
"অনেকবার চেষ্টা করলাম,  পারছিনা কেন রে?"
বেনামী পাশ ফিরে বদনামের দিকে তাকায়....
"আমিও পারিনি..." বেনামী আবার আকাশের দিকে ফেরে...
"ছটা পেপার জাস্ট নষ্ট করলাম"- বদনাম অধৈর্য...
"আগুন আঁকা যাবে? কান্না... রক্তপাত.. আঁকতে পারবি? "
-বদনামের চোখে চোখ রাখে বেনামী...
-বদনাম তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক...
বেনামীর ঠোঁটটা কাঁপছে...
ওর কাঁধটা চেপে ধরে বদনাম বলে -"কাঁদবি না"...
ভীষণ রাগে এভাবেই কেঁদে ফেলে বেনামী...

- সেই রাতটা মনে পড়ে ওর... ইচ্ছে করে তৈরী করা লোডশেডিং, মাঝারাতে আচমকা ঘরে ঢুকে পড়া কতগুলো লোক... মারধর আর চিৎকার, মায়ের কোলের ভেতর আরও লুকোতে থাকা ও নিজে আর সকাল হতেই দেখতে পাওয়া দেওয়ালে রক্তের ছোপ আর লন্ডভন্ড ভাড়াবাড়ির ঘর...
রঙ-লাগা দু'হাতে বদনাম, বেনামীকে জড়িয়ে নেয়...
ছুঁয়ে দেয় কাঁপতে থাকা বুক... কাঁপতে থাকা ঠোঁট...
ওই দু'হাতের ভেতর বেনামী শান্ত হয়ে আসে...
বদনামের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না,  আলতো হাসে...
সেই দেখতে -চাওয়া হাসিটা আরেকবার ছুঁয়ে নেয় বদনাম....

ও পারবে... পারবেই...
আগুন...  ওকে আঁকতেই হবে....

সামনের আকাশের  সদ্যবিকেলের সেই নরম আলো....
উজ্জ্বল.... আরও উজ্জ্বল হলুদ... তারপর গাঢ় লাল মিশতে মিশতে এলোমেলো...

নিবিড় হতে হতে.... খসে যাচ্ছে সব নীরবতা...
না-পারাগুলোর ভেতরেও এত শক্তি থাকে!

বেনামী ..  তখনও বদনামের দিকে তাকিয়ে....

ওরা ভাবছে... মৃত্যুগুলোকে হারিয়ে দেওয়াটা জয়, না  জয়... বেঁচে থাকা....

Saturday, May 5, 2018

সরলরেখাঃ দু'জন এবং... :৩

এই ব্যতিব্যস্ত শহরে গরমের দুপুরগুলো বড়ো নির্দয়... একেই কারণে-অকারণে সবাই দৌড়াচ্ছে, তার ওপর সুতির জামা-হালকা রঙ-মনে করে ছাতা-রোদচশমা-ইচ্ছে হলে সানস্ক্রিন-ফলের রস এতো কিছুর সতর্কতা আর কাগজ জুড়ে হিটস্ট্রোকের চোখরাঙানি...
ওই ব্যস্ততার এককোণে দাঁড়িয়ে থেকে দেখো... যাবতীয় লোকজনের  সাবধানতা-"সেল্ফ কেয়ার"-অপ্রস্তুতি... এদিকসেদিক...
... কেউ আড়াল করছে চোখ,  কেউ ঢেকে নিচ্ছে স্লিভলেস-হাত, কেউ ঢুকে যাচ্ছে ছায়ায়, কেউ চেয়ে নিচ্ছে আইসক্রিম...
বড়ো রাস্তা-অটোর লাইন -স্কুলগেট-রিক্সা স্ট্যান্ড- খাবার দোকান-সবজি বাজার... ছড়িয়ে থাকা ক্লান্ত-ব্যস্ত-বিরক্ত ভিড়ে... মিশে যাচ্ছে ফুল-ফুল কিশোরী-ছাতা...একরঙা অফিসের ছাতা...  চকচকে সস্তার ছাতা... চিরকেলে গম্ভীর কালো ছাতা... রক্তদান শিবির থেকে দেওয়া এত্তোবড়ো ছাতা... হাতে ফ্রিল বসানো মায়ের ছাতা... কোনা-ছিঁড়ে যাওয়া কাজ-চালানো ছাতা... হলুদের ওপর হাসিমুখ আঁকা ছোটদের ছাতা... আর পাঁচ-ছ'টা ওই একই দেখতে "দামাদামি করবেন না"-ছাতা...

এ'রকমই একটা দুপুর দেখতে দেখতে,  বেনামী এসে দাঁড়ায় মেট্রো স্টেশনের বাইরে...
ফলের রসের দোকানে তখন মাঝ-দুপর ভিড়...
অন্য দিন গুলোয় যেখানে দাঁড়ায় আজও সেখানে, একটা ছোট্ট মেসেজ পাঠায় বদনামকে- "পৌঁছলাম"...
ওদিক থেকে উত্তর আসেনা... কী জানি একটু চঞ্চল হয়েই আরেকটা মেসেজ পাঠায় - " অটোর সামনে তো? সাবধানে আয়..."  
চারদিকে তাকিয়ে  বেনামীর তেমন করে কিছু চোখে পড়ে না, চড়া রোদ  আর চারপাশের অতিরিক্ত হয়ে যাওয়া রঙ গুলো ওর খুব একটা ভালো লাগে না...
গরমের ছুটি শান্ত দুপুরের পাখার আওয়াজ,  আর মায়ের আঁচল থেকে ওই যে রান্নাঘরের গন্ধ - বেনামীর হঠাৎ যেন মনে পড়ে যায়...

সপ্তাহের এই একটা দিনই ওদের কাজ-কলেজ তাড়াতাড়ি থামে... তারপরই একজন মেট্রো...আর একজন বাস... 
... বেনামী ব্যাগের ভেতর, তখন ল্যাবে ফেলে-আসা রুমালটা খুঁজছে...
অটোটা এসে থামতে,  তাকিয়ে দেখে সামনের বাঁদিকের সিট থেকে নামছে বদনাম...
বেনামীর ঠোঁটে তখন অজান্তে-হাসি...
"এই রোদের মধ্যে কেউ দাঁড়ায়! ওই দিকেই তো ছায়া ছিল!" - আর্ট পেপারের রোল গুলো সামলাতে সামলাতে বকুনি দেয় বদনাম...
রোজ যেখানে দাঁড়ায় সেখানেও যে রোদ,  খেয়াল করেনি ছাতা-অপছন্দ বেনামী...
" আমি দাঁড়াই"- দুষ্টু হাসে বেনামী...

পকেট থেকে ছোট্ট নোটবুক বের করে বেনামীকে দেখায় বদনাম....
"তিনমাস বাকি, আর".... "একগাদা কাজ বাকী তাই তো?" -বদনামের কথাটা বলে ফেলে বেনামী...
"প্রথম যে গ্যালারিটা তোকে দেখিয়েছি, ওখানে"-বেনামীর দিকে তাকিয়ে থাকে বদনাম...
"দরজা দিয়ে ঢুকে এগিয়ে  সামনের দেওয়ালে"-বেনামী চোখ সরায় না...

হাঁটতে হাঁটতে ওরা ততক্ষণে গঙ্গার ধার....
জলের ওপর শেষ-দুপুরের গ্রীষ্ম ফুরিয়ে আসছে....

ওরা কথা বলছে না...
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে ছুঁয়ে যাচ্ছে আঙুলে আঙুল...
ওরা পেরিয়ে যাচ্ছে ভোট চেয়ে চেয়ে বিশ্রী দেওয়াল লিখন- গাছতলার মন্দিরে চালানো উৎকট গান- হাত পাতা ভিখারী আর হাত পাততে শেখা তার  বছর আটেকের ছেলেটা...
ঘাটের সিঁড়ি  দিয়ে নেমে ওরা দাঁড়িয়ে থাকে খানিক...
মৃদু হয়ে আসা সূর্যের আলোয় বিকেল শুরু হবে...

"শোন"- আর কিছু বলতে পারেনা বদনাম...
বেনামীর রোদে-পোড়া কপাল...  কপালের টিপ....তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর স্বপ্নগুলো মনে পড়তে থাকে....
বেনামী ওই দৃষ্টিটার দিকে তাকিয়ে থাকে....
ওদের চারপাশে তখন আরেকটা আগুন-বিকেল...

বেনামী ভাবতে থাকে... এটা ভালোবাসা না "ভালোবাসি"...




Friday, April 27, 2018

সরলরেখাঃ দু'জন এবং... : ২


সারারাত বৃষ্টির পর যখন  ঘুম আসে ...  পুরনো চাদরটা কাঁধ অবধি টেনে নিয়ে আরও আলতো হয়ে আসা সময়টা জুড়ে এলোমেলো  হয়ে থাকে স্বপ্ন আর আলগা-বিনুনি-চুল... জানলা পেরিয়ে সদ্য-ফোটা কামিনীর গন্ধ মিশে যায় শোবার ঘরে... বেডরুমেও...
টালির চাল থেকে কোলাপসিবল-বারান্দা...  একতলার-সামনের-উঠোন...  রাতজাগা-অফিসের গ্লাসউইন্ডো...বহুতলের সামনে সার দেওয়া চারচাকা... চা-দোকানের ওপর ঝুঁকে পড়া বোগেনভিলিয়া... ভেজে সব... শুধুই ভেজে...
তারপর ঘুম আসে...

এর'মই একটা রাতে... ওদের কথা হচ্ছিল...
ক্যানভাসে তখন পুরোনো কলকাতা-ট্রাম...
বেনামীর অনর্গল কথায় তখন মেট্রোর ভিড়-প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার এক্সটারনাল -নাটকের টিকিট-ক্যামেরার লেন্স...
ক্রিমসনে আরও একটু রাধাচূড়া-হলুদ মেশাতে মেশাতে নরম হাসে বদনাম...
বৃষ্টি, ঝিরঝির ছেড়ে ঝমঝম হয়ে নামে...
বদনাম জানে...  বেনামী এবার হঠাৎ...  চুপ হয়ে যাবে...
" কী হল?" - জিজ্ঞেস  করলে বলবে -" কিছু না"...

ফোনের ওপারে বৃষ্টির শব্দ আরও স্পষ্ট শুনতে পায় বদনাম...
বিছানার পাশের জানলার দ্বিতীয় পাল্লা খুলে দেয় বেনামী...
রাস্তার আলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে চুপ করে...
"সারারাত জেগে শেষ হবে,  তাই তো?" -বেনামীই আবার ছুঁয়ে দেয়....
ক্যানভাসে... ট্রামের দু'পাশের রাস্তায় সন্ধ্যে...সন্ধ্যের গায়ে মারাত্মক কৃষ্ণচুড়ার লাল... আর রাস্তার আগুন-আলো...
বেনামীর জানলা দিয়ে যেমন দেখাচ্ছে...

নিজের ক্যানভাসটার দিকে সম্পূর্ণ তাকিয়ে দেখে বদনাম...
চোখ মুছতে গিয়ে ওই আলো-রঙ লেগে যায় ঘুম-হারানো ডান চোখের তলায়...
... বেনামী, তখন গান গাইছে....

বৃষ্টি কমে আসে...
"কী রে,  তোর ঘুম নেই? " -বদনাম, সামলে নেয় নিজেকে...
বেনামী বুঝতে পারলো বোধহয়....
"এই তো..." - বেনামী গানের সুরটা গুনগুন করে আরও একটু.....


 ঘুম আসে... সেই ঘুমের ভেতর এলোপাথাড়ি খারাপস্বপ্নগুলো বদনামের গা থেকে খসে যায়...
রঙের নতুন শিশি খোলার ওই অদ্ভুত অনুভূতিটা, দু'হাতের পাতায় চঞ্চল হয়...

বেনামীর চোখে এবার জল আসে...
"রাখি..."- আগলে নিতে চায় বেনামী....

ঘুম আসে....
বদনাম... সারারাত ভাবতে থাকে...
বেনামী ওর প্রিয় না ভালোলাগা...?


Saturday, April 21, 2018

সরলরেখাঃ দু'জন এবং... : ১


... এই ঋতুবদলের সময়গুলো বড়ো অদ্ভুত... অবাধ্য...
যেমন এই যখন-তখন-কালবৈশাখী বিকেলগুলো...

ব্যাগে ছাতা থাকেনা,
পায়ে হয় সরু হিল নয় মোজা...
আচমকা বৃষ্টিতে ভিজে-যাওয়া সাদা জামার-আড়াল হারায় কালো অন্তর্বাস...
দুপুরের ঝলসানো রোদ... উত্তাল ঝড় আর নরম সন্ধ্যের সঙ্গে নিজেকে নিঁখুত মেকআপের মতো মেলাতে পারেনা কিছুতেই...

এমনই একটা বেমক্কা দিনে ওদের দেখা করার কথা...
ওই সাড়ে ছ'টা নাগাদ দু'জনের যেখানে এসে দাঁড়ানোর কথা সেখান থেকে... রাস্তার মোড়-জেব্রা ক্রসিং গুছিয়ে দেখা যায়... ফেরার আগে ওখানেই যখন দু'জন একটিবার হাত ধরবে সেটা কেউ গুছিয়ে দেখতে পাবে না...

.....  বেনামীর গত পরশুই পরীক্ষা শেষ হয়েছে...  
জমে থাকা ঘুম দেড়দিন ধরে খরচ করে...  আজ অন্তত পৌনে দু'মাস বাদে কাজল পরল...



...বদনাম-ই আজ আগে পৌঁছালো.... 
একটু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বাসের শেষ পাদানি থেকে স্টেপ মিস হয়ে যাচ্ছিলো...
সামলে নিয়ে ফুটপাথ পেরিয়ে... ওই জায়গায়...
কৃষ্ণচূড়ায় আগের মতো হেলান দিলে... সোজা তাকালেই চোখ যেখানে পৌঁছায়....  বেনামী সেখান থেকেই রাস্তা পার হওয়া শুরু করে...
ওর রাস্তা পার হওয়াটুকু দেখতে দেখতে বদনামের অনেক কথা মনে পড়ে...

তারই মধ্যে বেনামীর হাইপাওয়ারের চশমা ঢাকা-চোখ দুটো কখন যে এক্কেবারে কাছে চলে আসে...
কোনোদিনই বদনাম মাপতে পারেনা...



...আবারও...
বেনামী ওকে চমকে দিয়ে...
জিজ্ঞেস করে ফেলল - "আরেকটা টিউশন ছাড়লি তো ?"

অপেক্ষার ভেতরেই কখন যে ও চলে এসেছে...
বুঝতে পারেনি... বদনাম...
যেমন বুঝতে পারেনি ওর দাদা মারা যাওয়ার মাসেই ও কীভাবে প্রেমে পড়েছিল...

"তুই কী করে বুঝলি?"- ছন্দে ফেরে বদনাম...
অনার্সের পরীক্ষা না-দিতে পারার দিন গুলো আবার চাপা পড়ে যায়...

"আমি কী করে বুঝলাম...?"
-বেনামীর না-বাঁধা চুল এলোমেলো উড়তে থাকে...

... রবিবারের কাগজের ভাঁজকরা  পাতাটা বদনামের বুকপকেটে রাখতে রাখতে
"এই মাসের ছ'নম্বর ইলাস্ট্রেশন... ২নম্বর সপ্তাহ" -মনে করিয়ে দেয় বেনামী...
বেনামীর হাতটা ছুঁয়ে থেকে... ও ভাবতে থাকে....

ও...  বেনামীকে খুব ভালোবাসে...  না ভীষণ...?